রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগেই ক্রেমলিনে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি দিল্লির সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। 2014 সালে ব্রাজিল ব্রিকস সম্মেলনে বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, “ভারতের প্রতিটি শিশু জানে রাশিয়া আমাদের প্রিয় বন্ধু।”এমনও দিন গিয়েছে, যখন দুই দেশের নেতৃত্ব বুক ঠুকে দাবি করত যে, তাদের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে । যদিও, বর্তমানে সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে ।
ভারত ক্রমশ আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, এই সন্দেহে রাশিয়া ইসলামাবাদের দিকে ঝঁকতে শুরু করেছে । ঠিক এই সময়ই ভারতও ঠিক এই সতে্যর মুখোমুখি হয়ে বিপদ দেখতে শুরু করেছে ৷ ঠিক যে ধরনের প্রতিরক্ষা সামগ্রী তারা রাশিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিল তা চিনেও যাচ্ছে । এর প্রভাব দু’দেশের সম্পর্কে গিয়ে পড়েছে। খবর মিলেছে যে আফগান শান্তি আলোচনায় ভারতের বাইরে থাকা নিশ্চিত করেছে রাশিয়াই ।
গত বছর ডিসেম্বর মাসে ভারত–রাশিয়া সামিট মিট হওয়ার কথা ছিল । যদিও কোভিড প্যানডেমিককে এই সম্মেলন বাতিল হওয়ার কারণ হিসাবে দায়ী করা হচ্ছে ৷ তবুও এ কথাও জানা গিয়েছে যে, এই পদক্ষেপের পিছনে অন্য কারণ রয়েছে ।
চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে যে পুতিন–মোদি সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, তার প্রস্তুতির অঙ্গ হিসাবে, দুই দেশের বিদেশমন্ত্রীরা 2021 সালের 6 এপ্রিল দিল্লিতে সাক্ষাৎ করেছিলেন। 2018 সালে আমেরিকার বিধিনিষেধের হুঁশিয়ারি উড়িয়ে ভারত রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে সই করেছিল এস–400 ভূমি থেকে বায়ু পাল্লার মিসাইল সিস্টেম কেনার জন্য । এর পর সাম্প্রতিক এই দু’দেশের বিদেশমন্ত্রীদের সাক্ষাতের আগেও আমেরিকার হুঁশিয়ারিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি । এক যৌথ বিবৃতিতে ভারত এবং রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী, যথাক্রমে মি. জয়শঙ্কর এবং মি. সার্গেই ল্যাভরভ ঘোষণা করেছেন যে, দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় বসবেন । এই বয়ানের নির্যাস হল এই যে, এই দুই দেশ সম্পর্কের পারস্পরিক নীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে । সম্পর্ককে দৃঢ় করার এই যৌথ উদে্যাগে দুই দেশই লাভবান হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভাজনের আগে মস্কোই ছিল ভারতের একমাত্র বিশ্বস্ত প্রতিরক্ষা মিত্র । কিছু মতের অমিলকে বাদ দিয়ে পুতিনও সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী হিসাবে ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই চলেছেন । ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক, প্রতিরক্ষা এবং শক্তিসম্পদ ক্ষেত্রে সহযোগিতা চায় । যদিও এমনও কিছু সময় এসেছে যখন রাশিয়া নিজের অগ্রাধিকারগুলিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ভারতকে অবহেলা করেছে ।
আরও পড়ুন: রাশিয়ান বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন জয়শংকর
ভারতের তরফে আয়োজিত ফাইটার জেটের নিলামে রুশ মিগ, অংশ হতে পারেনি । ফলে মস্কো ভারতকে অ্যাটোমিক রিঅ্যাকটর সরবরাহ সংক্রান্ত নির্দেশিকায় সংস্তার আনার দাবি শুরু করে । 18 বছর আগে পুতিন ভারত, চিন ও রাশিরার মধে্য ত্রি–দলীয় জোট গঠনের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন । সম্প্রতি, দেখা যাচ্ছে, পুতিন ক্রমশ বেজিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন ।
মার্কিন নীতির লক্ষ্য চিনের অর্থনৈতিক শক্তিকে দমনকরা আর অন্যদিকে রুশ সেনা পুতিন এবং শি জিনপিংকে কাছাকাছি আনতে উদ্যত হয়েছে । ইন্দো–প্যাসিফিক এলাকায় চিনের আগ্রাসী কার্যকলাপ ওই এলাকার পড়শি দেশগুলির কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু রাশিয়া এই বিষয়টিকে একেবারেই আমল দিতে নারাজ । চিনের দাপট খর্ব করতে ভারত কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউকিটি ডায়লগ (কোয়াড)–এ যোগ দিয়েছে ৷ যা গঠিত হয়েছে ভারত, আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে। এর ফলে রাশিয়া অভিযোগ তুলেছে, ভারত আমেরিকার হাতের দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছে । রাশিয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট, তারা ভারত–রাশিয়ার সম্পর্কের যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাকেই ইঙ্গিত করছে । চিন এর ফায়দা তুলতে পারে ৷ যদি এই দূরত্ব আরও বাড়ে বা সম্পর্ক আরও খারাপ হয় ।
ভারত স্পষ্টভাবে নিজের কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, একটি দেশের সঙ্গে তাদের কৌশলগত সম্পর্ক থাকার অর্থ এই নয় যে, অন্য দেশ থেকে তাদের দূরত্ব বাড়বে । ভারতের উচিত নিজেদের বাণিজ্যের স্বার্থে এবং আমেরিকা ও রাশিয়া, দু’দেশের সঙ্গেই নিজেদের কূটনৈতিক অবস্থানকে সমানভাবে ক্ষুরধার করে তুলতে উদে্যাগী হওয়া । আবার এই একই সময়ে তাদের এটাও নিশ্চিত করা উচিত যে, চিন যেন কোনওভাবেই নিজেদের সীমা না লঙ্ঘন করে । এই ধরনের কূটনৈতিক পরাক্রমই একমাত্র দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে একটি সুরক্ষা আবরণী গড়ে তুলতে সহায়ক হবে ।