হাইডেলবার্গ, 12 মে : একজন বৈজ্ঞানিকের হাতে দেশ চালানোর ভার থাকলে কীভাবে প্যানডেমিকের মতো একটা ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য বিপর্যয় মোকাবিলা করা যায়, জার্মানি তার প্রমাণ । অনেকেই হয়ত জানেননা যে চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মর্কেল কোয়ান্টাম রসায়নশাস্ত্রে ডক্টরেট । তাই তিনি যখন দু'মাস আগে বেশ নিস্পৃহভাবে বলেছিলেন যে দেশে অন্তত 60-70 শতাংশ মানুষের COVID 19 হতে পারে, তখন অনেকেই বেশ আঁতকে উঠেছিলেন । তাঁরা বুঝতে পারেনি এটা একঢিলে দুই পাখি ।
প্রথমত এই সংক্রমণের বিশালতা আর ভয়াবহতার সম্বন্ধে জনসাধারণকে একটা আন্দাজ দেওয়া, অকারণ ভীত-সন্ত্রস্ত না হয় । আর দ্বিতীয়ত, এই সংক্রমণ মোকাবিলা করার জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আরও জোরদার করার ভিত্তি তৈরি করা । তার ফল আজ সর্বজনবিদিত । জার্মানিতে কোরোনার মৃত্যুহার সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন, সংক্রমণেরও হার নিম্নগামী । আর ক্রমে জীবন স্বাভাবিকের দিকে অগ্রসর হচ্ছে । মোটামুটি এক মাসের মধ্যে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠছে ।
কোরোনা আতঙ্কে ফাঁকা পড়ে আছে রাস্তার ধারে বসার জায়গাগুলি জার্মানির হাইডেলবার্গ শহরে কেটে গেল আট বছর । এখানেই 1386 সালে স্থাপিত হয় জার্মানির প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় । পাহাড় আর নদীতে ঘেরা ভারি সুন্দর, নয়নাভিরাম ছোট্ট এই শহরের জনবসতি মোটামুটি 1.5 লাখ । এই বিশ্ববিদ্যালয়তেই আমি ও আমার স্ত্রী গবেষণা করি । আমাদের এক পুত্রসন্তান, নবম শ্রেণিতে পড়ে । সেই একদিন খবর আনল যে ওদের স্কুলের একাদশ শ্রেণির একটি ছেলে সংক্রমিত, তার পরিবারের কোনও সদস্য সদ্য চিন থেকে বেড়িয়ে এসেছেন । সেই ক্লাস বন্ধ করে দেয়া হল তৎক্ষণাৎ । কিন্তু আমাদের বলা হল এই খবর না ছড়াতে, বা আতঙ্কিত না হতে । কিছুদিন বাদে ছেলের ক্লাসের একজনের মায়ের সংক্রমণ হয়েছে বলে শুনতে পেলাম । আমরা স্কুলে জিজ্ঞেস করতে বলা হল যে ছুটি দেওয়ার কথা চলছে, কিন্তু রাজ্য সরকারের স্তরে সেই সিদ্ধান্ত হবে, শহর বা স্কুল পর্যায়ে নয় । সেদিন 13 মার্চ । দুপুরেই জানিয়ে দেয়া হল যে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত স্কুল আপাতত বন্ধ । আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । আমাদের কর্মস্থানে আগেই বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ।
লকডাউনে জনশূণ্য হাইডেলবার্গের রাস্তা ছেলের স্কুল বন্ধ হতে প্রথমে, বলতে নেই, বেশ পুলকই জেগেছিল । কারণ রাস্তাঘাটে ঘুরতে মানা নেই (দু'জনের বেশি একসঙ্গে না বেরোলেই হল), পাড়ার পার্কে যেতেও মানা নেই । সুপারমার্কেটও খোলা, শুধু একসঙ্গে বেশি লোক ঢুকতে পারবে না । আমাদের জানানো হল যে, কোন উপসর্গ দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে সাত দিন অপেক্ষা করতে, তা প্রশমিত হয় কি না দেখতে । যদি না হয়, তবে ফোন করলে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িতে এসে নমুনা নিয়ে যাবেন । তারপর যদি সংক্রমণ হয় আর উপসর্গ বাড়তে থাকে, তাহলেই হাসপাতালে স্থানান্তর হবে । নচেৎ নয় । নিয়মকানুন মেনে চলতে লাগলাম সবাই । আমাদের বাড়িতে চারটে ফ্ল্যাট, তাতে আমাদের প্রতিবেশী দুই বৃদ্ধ । দুজনেরই ষাটোর্ধ্ব, দুজনেই একেবারে একা । চেষ্টা করতে লাগলাম তাদের যতটা সাহায্য করা যায়, বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে এনে দেওয়া বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ ভাগ করে নেওয়া । কিন্তু তাঁদের উদ্দীপনা আমাদের থেকে ঢের বেশি, তাঁরা আমাদের নিয়মিত খোঁজখবর নেন, বলেন তোমরা আমাদের দেশে অতিথি, আমাদের কর্তব্য তোমাদের দেখাশুনো করা । শীঘ্রই দেখলাম এই দু'জন আর আমাদের তৃতীয় প্রতিবেশিনী - তিনিও নিতান্ত তরুণী নন, পঞ্চাশের শেষ কোঠায় বয়স – তিনজনে মিলে প্রবল উৎসাহে বাগান পরিচর্যা শুরু করেছেন । আমাদের বাড়ির পেছনে অনেকটা জমিতে বাগান । আপেল, আঙুর, নাসপাতি, বিভিন্ন ফুল - নানান গাছ-গাছালি । জিজ্ঞেস করতে বললেন “অনেকদিন বাগানে হাত পড়ে না, এই সুযোগে বাগানটাকে ঝকঝকে করা যাক, কি বলো?” জার্মানরা কর্মবীর, ফালতু সময় নষ্ট করার ঘোর বিরোধী !
হাইডেলবার্গ থেকে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানাচ্ছেন আদিত্য ঘোষ জার্মানিতে 60 ভাগের ওপর মানুষই ষাটোর্ধ্ব, তাই এখানে তাঁদের মাধ্যমে সংক্রমণের ভয় অনেকটাই বেশি । কিন্তু এখানকার বয়স্ক মানুষজন ইট্যালি বা স্পেনের বয়স্কদের মতো অতটা ফূর্তিবাজ নয় বা সারাক্ষণ পার্টি করার ফিকির খোঁজেন না । নিজের কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, নিয়মানুবর্তিতা আর অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে এঁদের জুড়ি মেলা ভার । বিশেষত বয়স্ক জার্মান, যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, অথবা তার পরবর্তী কঠোর সময়ের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন । তুলনায় বরং তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি বেপরোয়া আর খামখেয়ালি । সেই জন্যই এখানে সংক্রমণটা বেশিরভাগ ছড়িয়েছিল অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে, তারা দুর্যোগ অমান্য করে, ঝুঁকি নিয়ে, স্কি করতে গিয়েছিল ইট্যালিতে ।
আপাতত বইপত্র, সিনেমা, গানবাজনা, রান্নাবান্না ইত্যাদিতে দেড়মাস দিব্যি কেটে গেছে । যেহেতু আমাদের গবেষণার কাজের অধিকাংশই বাড়িতে বসে করা সম্ভব, তাও চলছে, বেশ কিঞ্চিৎ ফাঁকিবাজি সহযোগে । বিরিঞ্চিবাবা যেমন বলেছিলেন, বর্তমান বলে কিছু নেই, তেমনই একটা মাস অতীত । এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ।