ভারতের সাইবার বিশেষজ্ঞ পুখরাজ সিং টুইটারে জানিয়েছেন, কুডানকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার বোর্ড (KNPB)-এর যোগাযোগ ব্যবস্থা হ্যাক হয়ে গেছে । এই খবর সারা দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে ।
জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সমন্বয়কারী লেফটেনেন্ট জেনেরাল রাজেশ পন্থ জানিয়েছেন, এই সাইবার আক্রমণটি ঘটে সেপ্টেম্বর মাসে । 29 অক্টোবর এই খবরটি দাবানলের মতো খবরের চ্যানেলগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে । KNPB কর্তৃপক্ষ অবশ্য প্রাথমিকভাবে এই খবরের সত্যতা স্বীকার করতে চাননি । তবে, ওই একই সংস্থা 24 ঘণ্টা পরে মেনে নেয় সাইবার হানার কথা ৷ নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড (NPCIL) 30 অক্টোবর জানায়, চলতি বছর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় কুডানকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট (KKNPP)-এর প্রশাসনিক নেটওয়ার্কে ‘ডি-ট্র্যাক’ নামক একটি ম্যালওয়্যারের অস্তিত্ব মিলেছে । এই ম্যালওয়্যারটির সাহায্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার হ্যাক করা হয় । যদিও কেন্দ্রের প্রযুক্তি দপ্তর থেকে দাবি করা হয়, তাদের কম্পিউটারগুলি সম্পূর্ণ নিরাপদ কারণ এগুলি ‘এয়ার-গ্যাপড’ । তাই এই কম্পিউটারগুলি হ্যাক করা অসম্ভব । ‘এয়ার গ্যাপড’ সিস্টেমের অর্থ, এই সব কম্পিউটারগুলি কোনওরকমভাবেই কোনও নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত নয় । আর এই কারণে এগুলি হ্যাক করাও সম্ভব নয় । অন্যদিকে, ভারতের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র (ISRO)-ও ডিট্র্যাক হামলার বিষয়ে সতর্কবার্তা পেয়েছিল । এই সতর্কবার্তা এসেছিল চন্দ্রযান-২-এর লঞ্চের সময় ।
এই ধরনের আক্রমণ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলিতে নিরাপত্তার ফাঁক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় । সাধারণত উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা এই ডিট্র্যাক ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে । এরা তথ্য চুরি করে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় হামলার ছক কষে । এই ম্যালওয়্যার দিয়েই দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্কিং এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের বিভিন্ন নথি হ্যাক করা হয় । ভারতের ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার (BARC)-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান এস এ ভরদ্বাজের দাবি, তিনি ই-মেইলের মাধ্যমে এই ধরনের ম্যালওয়্যার পেয়েছেন । ভাবার প্রাক্তন কর্তা হওয়ার পাশাপাশি তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাটমিক পাওয়ার কোম্পানির টেকনিক্যাল ডিরেক্টর এবং থোরিয়াম নির্ভর AHWR রিয়্যাকটরের বিজ্ঞানী । উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ইউরেনিয়াম নির্ভর পরমাণু প্রযুক্তি থেকে সরে এসে থোরিয়াম নির্ভর পরমাণু প্রযুক্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে । আর তাই তারা ভারতের দিকে নজর দিয়েছে । ভারতে থোরিয়াম নির্ভর পরমাণু প্রযুক্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী । থোরিয়াম নির্ভর পরমাণু প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা দেশগুলির দিকে নজর রয়েছে চিনেরও । পরে জানা যায়, এই ধরনের ম্যালওয়্যারের ই-মেইল পেয়েছেন বিশিষ্ট ভারতীয় বিজ্ঞানী অনিল কাকোদকর ।
ভয়ঙ্কর উত্তর কোরিয়া
আধুনিক যুগে যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যাপ্তি অনেকটাই বেড়েছে । জল, স্থল, আকাশ এবং মহাকাশ ছাড়িয়ে তা এখন সাইবার নিরাপত্তার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে । নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে বা তাতে বড়সড় সমস্যা তৈরি করতে সাইবার আক্রমণের জুড়ি নেই । সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা সিমেনটেকের সমীক্ষা অনুসারে, সাইবার আক্রমণের শিকার হতে পারা দেশের তালিকায় ভারতের স্থান একেবারে উপরের দিকে । সিমেনটেকের মতে, অ্যামেরিকা ও চিনের পরে ভারতেই সাইবার আক্রমণের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি । সাইবার নিরাপত্তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা ও চিন কিন্তু ভারতের চেয়ে এখন অনেকটাই এগিয়ে । প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছে তারা । 2018 সালে 36টি রাজ্যে গভর্নর নির্বাচনের আগে সাইবার সুরক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সিকে ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়া বন্ধ করে অ্যামেরিকার সাইবার কম্যান্ড । ইন্টারনেটের উপর অ্যামেরিকার একছত্র আধিপত্যের প্রমাণ মিলেছিল কখনওই । 2019 সালের 2 মে রাশিয়া সার্বভৌম ইন্টারনেট আইন পাশ করে । এর ফলে পুরোনো ব্যবস্থা থেকে আলাদা হয়ে রাশিয়া নিজেদের DNS সার্ভার দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে । খুব শীঘ্রই রাশিয়া তাদের নিজস্ব ইন্টারনেট RUNET-এর পরীক্ষা করবে ।
সাইবার আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে রাশিয়ার এই উদ্যোগ থেকে মনে হয় ভারত কিছুই শেখেনি । সরকার বলছে, আমাদের কম্পিউটারে সাইবার হানা হওয়া অসম্ভব, কারণ এগুলি এয়ার গ্যাপ অবস্থায় রয়েছে । ইতিহাস কিন্তু সরকারের এই দাবি সমর্থন করে না ।
ইরানের পরমাণু প্রকল্প বানচাল করে দিয়েছিল অ্যামেরিকা। প্রথমে তারা ইরানের নানতেজ ইউরেনিয়াম শোধনাগারে যন্ত্রপাতির জোগান দেয়, এমন চারটি সংস্থাকে চিহ্নিত করে । পরে স্টাক্সনেট নামক ডিজিটাল অস্ত্র দিয়ে অ্যামেরিকা ওই চার সংস্থাকে নিশানা করে । এই চারটি সংস্থার কোনও একজন কর্মচারী নানতেজ পারমাণবিক কেন্দ্রের কম্পিউটারে একটি পেন ড্রাইভ লাগায় । শুধুমাত্র এই কাজ করার জন্য 984টি গ্যাস সেন্ট্রাল ফিউজ় অকেজো হয়ে যায় । এর ফলে এখনও পর্যন্ত ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি । অ্যান্টি-ভাইরাস প্রস্তুতকারক সংস্থা ক্যাসপারস্কাইয়ের মতে, মানুষের একটা ছোটো ভুলে কর্পোরেট জগতের 90 শতাংশ ক্ষেত্রে সাইবার হানা হতে পারে । খুব পোক্ত সাইবার নিরাপত্তা না থাকায় মার্কিন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সরঞ্জাম দেওয়া ছোটো ঠিকাদারদের নিশানা করে চিন । এর আগে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কম্পিউটারে হানা দিয়েছিল চিন । এমনকি, চিনে তৈরি হওয়া হার্ডওয়্যারও নিরাপদ নয় মোটেই ।
CIA পর্যন্ত চিনের সাইবার হানার হাত থেকে রক্ষা পায়নি । অ্যামেরিকারই সুপার মাইক্রো নেটওয়ার্কিং সার্ভারের পরিষেবা ব্যবহার করে এই হামলা চালায় তারা । এর ফলে ড্রোনের মাধ্যমে নেওয়া ছবির মান খারাপ হয়ে যায় । সুপারমাইক্রো বাবহারকারী কম্পিউটারের প্রধান অংশগুলি তৈরি হত চিনে । ব্লুমবার্গের একটি রিপোর্টের দাবি, এই অংশগুলিতে ধান বা চালের আকারের ছোটো একটি ক্ষতিকর চিপ বসিয়ে এই কাজ করেছিল চিন । তবে, সরকারিভাবে অ্যামেরিকা কখনই এই ধরনের ঘটনার কথা স্বীকার করেনি । তবে এরপর থেকে চিন থেকে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার আমদানিতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করেছে অ্যামেরিকা ।