চিনের ইউহান প্রদেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলে কোরোনা ভাইরাস (Covid-19), শুধু চিনের অন্যত্রই ছড়িয়ে পড়ছে না । চিনের সীমানা ছাড়িয়ে তা এ বার ছড়িয়ে পড়ছে অন্য দেশেও । ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে এখনও পর্যন্ত 16টি শহর তালাবন্ধ করেছে চিন । এইসব শহরের বহুতলগুলিতে মানুষের অবাধ গতিবিধিতেও রাশ টেনেছে চিনা প্রশাসন । একাধিক বিধিনিষেধের সঙ্গে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে শারীরিক পরীক্ষাও বাধ্যতামূলক হয়েছে এ সব শহরে । এই সব বিধিনিষেধের ফলে চিনা নববর্ষ পালনের পর বাড়ি থেকে আর কাজে যোগই দিতে পারেননি প্রায় 70 লাখ শ্রমিক । এর ফলে হেনান, হুবেই ঝেজিয়াং, গুয়াংগংয়ের মতো শহরে বিপর্যস্ত অবস্থা বিভিন্ন কারখানার । হেনান প্রদেশেই রয়েছে অ্যাপল আইফোনের বিশ্বের সর্ববৃহৎ কারখানা । হুবেইয়ের রাজধানী উহান প্রদেশে হন্ডা, নিশানের মতো জাপানি গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা ছাড়াও রয়েছে একাধিক ইউরোপীয় গাড়ি সংস্থা । জার্মানির ভোক্স ওয়াগন গ্রুপ বেজিংয়ে তাদের সাড়ে তিন হাজার শ্রমিককে আগামী দুই সপ্তাহ কারখানায় না গিয়ে বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে । জার্মানির BMW, অ্যামেরিকার টেসলা, ব্রিটেনের জাগুয়ার বা ল্যান্ডরোভারের মতো গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাও চিনে তাদের কাজকর্মে সমস্যার কথা উল্লেখ করেছে।
সমস্যায় পড়েছে সাপ্লাই চেনগুলিও
বিভিন্ন দেশের গাড়ি, ইলেকট্রনিকস, বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী তৈরির একাধিক কারখানা রয়েছে চিনে । এগুলির বেশির ভাগই অ্যামেরিকা, জার্মানি, জাপান এবং ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশের । আজকের দিনে প্রায় কোনও দেশেই কোনও সামগ্রীর সব যন্ত্রাংশ পুরোপুরি তৈরি হয় না । এক জায়গায় অ্যাসেম্বল করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় । উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কোনও দেশে যদি স্মার্টফোনের যন্ত্রাংশ তৈরি হয়, তা হলে ডিসপ্লে স্ক্রিন তৈরি হয় অন্য কোনও দেশে । একে বলে আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খল । এই সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রধান দেশগুলি হল তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া । কোরোনার ফলে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে এই শৃঙ্খলের উপর । ফলে, চিনের সঙ্গে অন্য দেশের আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । যেমন, বস্ত্র ও পরিশোধিত খাদ্য সামগ্রী চিন থেকে জাপানে রপ্তানি হয় । এই পরিস্থিতিতে এই ব্যবসা অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছে । চিন থেকে যথেষ্ট পরিমাণে কাঁচামাল না এসে পৌঁছানোয় হুন্ডাই মোটর কম্পানি দক্ষিণ কোরিয়ায় তাদের বেশ কিছু কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে । কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে এশিয়ার একাধিক দেশের মানুষ বাজার, শপিং মল বা রেস্তরাঁর মতো জনাকীর্ণ জায়গায় যেতে ভয় পাচ্ছেন । এর ফলে খুচরো ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে । চিন সরকার সে দেশে বেড়াতে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোয় এবং বিভিন্ন দেশ চিনা নাগরিকদের প্রবেশের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় প্রবল সংকটে পর্যটন শিল্প । কোনও সন্দেহ নেই, এর ফলে ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশে পর্যটন ব্যবসা বড় ক্ষতির মুখে পড়বে । কোরোনার আক্রমণে শুধুমাত্র সিঙ্গাপুরই প্রায় এক কোটি চিনা পর্যটক হারাবে বলে মনে করা হচ্ছে । হংকং, ম্যাকাওয়ের মতো ব্যবসার কেন্দ্রগুলিও বড় ক্ষতির মুখে পড়বে । তাইল্যান্ডের GDP-র 11.2 শতাংশ এবং হংকংয়ের GDP-র 9.4 শতাংশ আসে পর্যটন ব্যবসা থেকে । ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় চিনা পর্যটকের সংখ্যা যে হেতু কম, সে হেতু পর্যটন শিল্পে কোরোনার প্রভাব এই দুই দেশে বেশ কম । অন্যদিকে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়, লুফৎহানসা, এয়ার ইন্ডিয়ার মতো বিমান সংস্থা হয় চিনে তাদের পরিষেবা বন্ধ রেখেছে, বা অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছে । পর্যটন ও বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলির পরোক্ষ প্রভাব পড়তে পারে জাপানের টোকিয়োর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকসে । এ বারের অলিম্পিকস 24 জুলাই থেকে শুরু হওয়ার কথা । গাড়ি থেকে শুরু করে কারখানার যন্ত্রাংশ, ওষুধপত্র, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, কম্পিউটার, স্মার্টফোন-সহ বিভিন্ন উচ্চ প্রযুক্তির সামগ্রী তৈরির বড় কেন্দ্র চিন । কোরোনার প্রভাবে 2020 সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে গাড়ির উৎপাদন এক ধাক্কায় প্রায় 15 শতাংশ কমে যেতে পারে । গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির সংস্থা বশ, ম্যাগনা ইন্টারন্যাশনাল এবং ইলেকট্রনিকস সামগ্রী প্রস্তুতকারক সংস্থা এনভিডিয়াও তাদের উৎপাদন কমাবে বলে জানিয়ে দিয়েছে । এখনও অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে না উঠতে পারা বিশ্বের কাছে কোরোনার আক্রমণ তীব্র কষাঘাতের মতো এসে পড়েছে । চিন তো বটেই, এই ভাইরাস সারা বিশ্বের GDP নামিয়ে আনতে পারে । জার্মানির থেকে চিনে ভারী যন্ত্রাংশের রপ্তানিও অনেকটাই কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে ।
সুযোগের সদ্ব্যবহার