ওয়াশিংটন, 25 সেপ্টেম্বর : ইন্দো-প্যাসিফিক (Indo-Pacific) এবং বিশ্বে শান্তি আর উন্নয়নের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং আমেরিকা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের পেশিশক্তি ক্রমশ বেড়ে চলেছে, এই পরিস্থিতিতে কোয়াড গোষ্ঠীর (Quad) শীর্ষ নেতারা নতুন পদক্ষেপ করার কথা ঘোষণা করলেন শুক্রবার শীর্ষ বৈঠকে।
কোয়াড ‘বিশ্বের কল্যাণকর শক্তি’র (Force for Global good) ভূমিকা পালন করবে বলে জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Prime Minister Narendra Modi) তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, কোয়াডের ৪টি গণতান্ত্রিক দেশের সহযোগিতায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আর বিশ্বে শান্তি আর সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হবে।
কোয়াড গোষ্ঠীর প্রথম বৈঠকে হোয়াইট হাউজের (White House) ইস্ট রুমে (East Room) নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (President Joe Biden) । এর আগে দিনের শুরুতে তিনি এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন মোদির সঙ্গে । মোদিকে ‘আমার বন্ধু’ (My Friend) বলে উল্লেখ করেছেন বাইডেন ।
কোভিড মোকাবিলা থেকে জলবায়ুর মতো সাধারণ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে ৪টি গণতান্ত্রিক দেশ একসঙ্গে মিলিত হয়েছে, বৈঠকের সূচনায় একথা জানালেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন । তিনি বলেন, ‘‘এই গোষ্ঠীতে গণতান্ত্রিক সহযোগী রয়েছে, যাদের বিশ্ব আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি একরকম ।’’
৬ মাস আগের বৈঠকের কথা মনে করে বাইডেন বলেন, ‘৬ মাস আগে যখন আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল, তখন আমরা এই অধিবেশনকে স্বাধীন ও মুক্ত করতে চেয়েছি । আমাদের মধ্যে সদর্থক বিষয়গুলি ভাগ করে নিয়েছি । সেই উদ্দেশ্যে একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ।’’ ঐতিহাসিক ইস্ট রুম-এ উপস্থিত ছিলেন আরও দুই নেতা, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন (Australian Prime Minister Scott Morrison) এবং জাপানের ইয়োশিহিদে সুগা (Yoshihide Suga) ।
বৈঠকে ভ্যাকসিন উদ্যোগের সঙ্গে যোগ হয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গও ওঠে । বাইডেন জানান, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কোয়াড গোষ্ঠী নতুন পদক্ষেপ করবে, যাতে সমুদ্র বা জলভাগে জাহাজগুলি থেকে দূষণ না ছড়ায় ।
তিনি বলেন, ‘‘আজ, আমরা কোয়োড ফেলোশিপ (quad fellowship) চালু করছি । এতে আমাদের ৪টি দেশের ছাত্রছাত্রীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি, অঙ্কের বিভিন্ন প্রোগ্রামে (এসটিইএম) উন্নতমানের ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন ।’’
৪টি দেশেরই একে অপরকে সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে জানিয়ে বাইডেন বলেন, ‘‘আমরা জানি কী ভাবে কোনও কাজ করতে হয় । আর আমরা যে কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ।’’
আরও পড়ুন : পাক-অধিকৃত কাশ্মীর থেকে সরে যাক পাকিস্তান, রাষ্ট্রসংঘে দাবি ভারতের
এই ঐতিহাসিক ও প্রথম সামনাসামনি কোয়াড বৈঠকের আয়োজনের জন্য বাইডেনকে ধন্যবাদ জানান মোদি । তিনিও ২০০৪ সালের কথা মনে করে জানান, সেই সময় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে এই ৪টি দেশ এক হয়েছিল । আজও তেমনই একটা সময় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আজ, যখন বিশ্ব কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের সঙ্গে লড়ছে, তখন আমরা কোয়াড হিসেবে ফের একসঙ্গে হয়েছিল এবং মানুষের স্বার্থে কাজ করছি ।’ কোয়াডের ভ্যাকসিন নিয়ে উদ্যোগের ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলি উপকৃত হবে ।’’
মোদি আরও বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যের একইরকম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে কোয়াড গোষ্ঠী সদর্থক চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । কোয়াড এক অর্থে বিশ্বের ভালোর জন্য একটা শক্তির ভূমিকা পালন করবে । আমি আত্মবিশ্বাসী যে কোয়াডের অধীনে আমাদের সহযোগিতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এবং বিশ্বে উন্নয়ন এবং শান্তি সুনিশ্চিত করবে ।’’
চিনের নাম না করলেও দক্ষিণ চিন সাগরে সে দেশের আধিপত্য প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জানান, ইন্দো- প্যাসিফিক অঞ্চলকে দখল মুক্ত করতে হবে । আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিতর্কগুলোর সমাধান করার প্রস্তাব দেন ।
মরিসন বলেন, ‘আমরা মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকে বিশ্বাসী। কারণ, তা জোরালো, সুসংহত এবং সমৃদ্ধ মুক্তির দিশা দেখাবে। একমাত্র তা হলেই উদারমনস্ক, মুক্ত সমাজে বাস করার আশা ও স্বপ্ন সফল হবে।’’ তিনি জানান, গণতন্ত্রের মাধ্যমে কী ভাবে এই কাজগুলো করা যায় তা দেখায় কোয়াড । যে কোনও জটিলতা আর পরিবর্তনশীল দুনিয়ার বড় বড় চ্যালেঞ্জগুলো সামলাতে পারে তারা ।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী সুগা বাকি ৩ জন নেতার মতোই এই প্রথম কোয়াড গোষ্ঠীর মুখোমুখি দেখা হওয়ার গুরত্বে জোর দেন । তিনি বলেন, ‘‘এই বৈঠক আমাদের ৪টি রাষ্ট্রের মধ্যে সুসংহত ঐক্যের নিদর্শন এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে আমরা সবাই অবিচল ।’
এই বৈঠকের আগে হোয়াট হাউজ জানিয়েছিল, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, জলবায়ু পরিবর্তন আর কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের মতো বিষয়গুলি ছাড়াও এই ঐতিহাসিক বৈঠকে কোয়াড গোষ্ঠীর নেতারা একটা নতুন কার্যপ্রণালীর কথা ঘোষণা করবেন। যেখানে একটা সরবরাহ শৃঙ্খলের উদ্যোগ (supply chain initiative) এবং ৫জি-র বিস্তারের (5G deployment) মতো বিষয়গুলি প্রাধান্য পাবে ।
ভারত, আমেরিকা আর বিশ্বের অন্য শক্তিশালী দেশগুলি চিনের ক্রমবর্ধমান সামরিক দৌরাত্ম্যের জেরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে মুক্ত, স্বাধীন করার কথা বলে আসছে ।
দক্ষিণ চিন সাগরের (South China Sea) সমস্ত বিতর্কিত অঞ্চলের দাবি জানিয়েছে চিন। যদিও তাইওয়ান (Taiwan), ফিলিপিন্স (Philippines), ব্রুনেই (Brunei), মালয়েশিয়া (Malaysia) এবং ভিয়েতনাম (Vietnam), সবাই তাদের নিজের নিজের জায়গার দাবি জানিয়ে আসছে । বেজিং দক্ষিণ চিন সাগরে বেশ কিছু কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে সেখানে সামরিক বাহিনীকে মোতায়েন করেছে ।
বৃহস্পতিবার কোয়াড বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী মোদি আলাদা করে অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন । তারা পুনরায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে স্বাধীন ও মুক্ত করার কথা বলেন । জলভাগে নিরাপত্তার গুরত্ব নিয়ে ফের একমত প্রকাশ করেন ।
২০১৭-র নভেম্বরে, ভারত, জাপান আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কোয়াড তৈরির প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করে । ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের বাড়তে থাকা সামরিক উপস্থিতিতে সমস্যাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সমুদ্রপথ । এই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল এর মোকাবিলায় নতুন কৌশল গঠন করা ।