অ্যামেরিকার আগামী নির্বাচনের জন্য রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প দলের জাতীয় সম্মেলনে বলেন, ‘‘যদি জো বিডেন নির্বাচনে জেতেন, তবে চিন আমাদের দেশকে দখল করে নেবে । আমি বিডেন নই, তাই চিন সারা বিশ্বে যে দুর্দশা ডেকে এনেছে, তার জন্য আমি তাদের দায়ী করবই ।’’ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী তথা প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বিডেনকে কটাক্ষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও বলেন, ‘‘আপনারা যদি লক্ষ্য করে থাকেন তবে দেখবেন যে, আমাদের দেশের সংস্থা ও কাজের সুযোগ যাতে আমাদের এখানেই থাকে সেটা আমি নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া কিছুদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছি এবং আগামীতেও সেটাই করে যাব । জো বিডেনের কর্মসূচি চিনে তৈরি হয়েছে । কিন্তু আমার কর্মসূচি অ্যামেরিকায় তৈরি হয়েছে ।’’
উল্লেখ্য, চিন ও অ্যামেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর 1979 সালে তরুণ সেনেটর হিসেবে জো বিডেন এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বেজিং সফরে গিয়েছিলেন । বারাক ওবামার আমলে জো বিডেন অ্যামেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন । সেই সময় তিনি এই মতের শরিক ছিলেন যে, উদীয়মান চিন এক যথার্থ উন্নতির প্রতীক । যদিও ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পর জো বিডেন যে ভাষণ দেন, তাতে চিন, রাশিয়া বা অন্য কোনও দেশের সঙ্গে অ্যামেরিকার বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত বিষয়ের কোনও উল্লেখ ছিল না । তবে দলের তরফে একটি বিতর্ক সভায় যোগ দিয়ে তিনি চিনের প্রেসিডেন্ট শি জ়িনপিংকে ঠগ বলেছিলেন ।
এই পরিস্থিতিতে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনী লড়াইতে ভোটার ও নীতি নির্ধারকদের কাছে কি চিন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইশু হতে চলেছে? নভেম্বরে ফল ঘোষণার পরেও কি চিনের সঙ্গে অ্যামেরিকার সম্পর্ক সংঘাতমূলক ও দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ থাকবে? আগামী দিনে চিন ও অ্যামেরিকার সম্পর্ক কীভাবে ভারতের উপর প্রভাব ফেলবে ? #BattlegroundUSA2020-র এই পর্বে এমন কিছু বিষয় আলোচিত হয়েছে । সাংবাদিক স্মিতা শর্মার প্রশ্ন, কোরোনা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে অ্যামেরিকায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে সমালোচনা শুরু হয়েছে, তা থেকে নজর ঘোরাতেই কি ট্রাম্প ভোটের আগে বেজিং বিরোধী তাস আরও জোরদারভাবে খেলবেন?
ওয়াশিংটন ডিসি-র ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের স্ট্র্যাটেজিক এক্সপার্ট তথা সিনিয়র ফেলো তনভি মদন বলেন, ‘‘অ্যামেরিকার নির্বাচনী লড়াইতে চিনকে ইশু করা নতুন নয় । সে দেশে নির্বাচনের সময় অর্থনীতি ও অন্যান্য কৌশলগত ক্ষেত্রে চিন বিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয় । প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিছুটা হলেও সেই তাস খেলছেন । কারণ আমার মনে হয় কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রশাসনের তরফে খামতি রয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেজন্য ট্রাম্পকে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে । তাই সেই সমালোচনার মোকাবিলায় ট্রাম্প পরিস্থিতির পুরো দায়ভার চিনের উপর চাপাতে চাইছেন । উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ট্রাম্প কোরোনা ভাইরাসকে কটাক্ষ করে চায়না ভাইরাস নামে অভিহিত করেছেন । তাই এক হিসেবে এমনটা বলা যেতেই পারে যে, ট্রাম্প যেন দেশের মানুষকে বোঝাতে চাইছেন যে, দেখুন এই ভাইরাসের প্রকোপ চিন আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং আমার প্রশাসন বিভিন্নভাবে তার মোকাবিলা করার চেষ্টা করে চলেছে । ট্রাম্প মনে করেন বিষয়টির এভাবে মোকাবিলা করা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক । তবে শুধু কোভিড নয়, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চিনের কাছে পিছিয়ে পড়ার বিষয়টিও রয়েছে । তাই ট্রাম্প মনে করেন, চিনের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার কথা বলে তিনি তাঁর ভোটারদের মন জয় করতে পারবেন ।’’ প্রশ্ন হল, চিন ইশুতে ট্রাম্প কি বিডেনকে নির্বাচনী লড়াইয়ে টেক্কা দিতে পারবেন এবং রিপাবলিকান দল কি নির্বাচনী লড়াইয়ের পুরোটাই চিনের বিরুদ্ধে এভাবে সুর চড়িয়ে প্রচার চালিয়ে যাবে? তা ছাড়া যদি ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় আসেন তবে কি তিনি চিনের উপর চাপ বজায় রাখতে পারবেন?
ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বিষ্ণু প্রকাশ যিনি দক্ষিণ কোরিয়া ও কানাডায় কর্মরত ছিলেন, তিনি এই বিষয়ে বলেন, ‘‘আমার মনে হয় যদি রিপাবলিকানরা আগামী নির্বাচনে জেতে এবং ট্রাম্প প্রশাসন ফের ক্ষমতায় আসে তবে চিনের বিরুদ্ধে এখন যে চড়া সুর রয়েছে তা কিছুটা হলেও নরম হবে । ডেমোক্রেট দল হয়তো মানবাধিকার বা ওই ধরনের কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলবে । তবে আমি মনে করি দূরত্ব এখন এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, সেটা পুরোপুরি মেটানো কারও পক্ষেই কার্যত অসম্ভব । পুরো বিষয়টাই ভৌগোলিক রাজনীতি ও অ্যামেরিকার আধিপত্য বজায় রাখাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে । আর কোনও অ্যামেরিকান নেতাই এই বিষয়ে সমঝোতা করতে রাজি নন । কারণ তাঁরা জানেন যে, অ্যামেরিকার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা থেকে চিন বিরত হবে না ।’’
তনভি মদন ‘‘ফেটফুল ট্রাই অ্যাঙ্গেল : হাউ চায়না শেপড ইউএস-ইন্ডিয়া রিলেশনস ডিউরিং দ্য কোল্ড ওয়ার’’ শীর্ষক একটি বই লিখেছেন । সেখানে তিনি বলেন, ‘‘ডেমোক্রেট দল চিন সম্পর্কে কথা বলেছে, তবে সেটা একটু ভিন্নভাবে । ডেমোক্রেটদের জাতীয় সম্মেলনে জো বিডেন হয়তো তাঁর ভাষণে এই বিষয়ে কিছু বলেননি, কিন্তু আপনি যদি অন্যান্য অনুষ্ঠানে ও অন্যান্য সময়ে ডেমোক্রেটদের বিবৃতিগুলি লক্ষ্য করেন, তবে দেখবেন যে তারাও বলছে, আমরা চিনের ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নেব । কিন্তু সেটা নেওয়া হবে অন্যভাবে । সেই পদক্ষেপ হবে কৌশলগত এবং তা নেওয়া হবে সহযোগী ও সঙ্গী দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে এবং নিরপেক্ষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অ্যামেরিকার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে । যদি ধরেও নিই যে, চিন ইশুতে অ্যামেরিকানরা ভোট দেবেন না, কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে অ্যামেরিকার বৈদেশিক নীতির কিছু কিছু বিষয় সম্ভবত ভোটারদের প্রভাবিত করবে । তবে সবদিক দিয়ে এবারের নির্বাচন আদতে আপনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কোন নজরে দেখেন সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ।’’
জুলাইতে AP-র তরফে চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, 61 শতাংশ অ্যামেরিকান কোরোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের কাজে খুশি নয় । এছাড়া 64 শতাংশ অ্যামেরিকান মনে করেন চিন COVID-19 সংক্রমণ ছড়ায়নি । তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পিউ পোল – এর ফলাফল বলছে, 73 শতাংশ অ্যামেরিকান চিনের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন । তাহলে কি অ্যামেরিকান কংগ্রেসে চিন বিরোধী মনোভাবের ক্ষেত্রে স্পষ্ট দ্বি-বিভাজন রয়েছে, যা এই রাজনৈতিক আক্রমণের জন্য দায়ী? ট্রাম্প যিনি অনেক সময় এমন কিছু কথা বলেন ও মনোভাব প্রকাশ করেন যা রাজনীতির মানদণ্ডে সঠিক নয়, তিনি কি চিনের ক্ষেত্রে অনমনীয় মনোভাব নিয়ে আগামীতেও চলতে পারবেন?