যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প পিছু হটার আগে তাঁর বিদায়বার্তায় বললেন যে, “আমরা যা করতে এসেছিলাম, তা করেছি”, তখন অ্যামেরিকায় একটা নতুন ইতিহাসের সূচনা হল । একটা নতুন সূর্যোদয় দেখা গেল, যখন প্রবীণতম ব্যক্তি হিসেবে জো বাইডেন নির্বাচিত হলেন সেই ভোটে, যা স্বাধীনতা ও সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকার আত্মাকে রক্ষার জন্য লড়া হয়েছে । মহিলাদের ভোটদানের অধিকার পাওয়ার একশো বছর পর অ্যামেরিকার ইতিহাসে প্রথমবার এক নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলেন । তাঁর দক্ষিণ ভারতীয় শিকড় নিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব গর্বিত হতে পারে ।
‘অ্যামেরিকা প্রথম’— এই স্লোগানকে সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প । চার বছরের শাসনকালে তিনি দেশকে একের পর এক সঙ্কটের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। ইতিহাসবিদরা বলছেন, এখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে তেমনই বড় চ্যালেঞ্জ, 1861-র গৃহযুদ্ধের পর যেরকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন, আর 1933 সালের অপ্রত্যাশিত মন্দার সময় যেমন সঙ্কটের মধ্যে গিয়েছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ।
ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন যে বহু দশকের মধ্যে তিনি তেমন প্রেসিডেন্ট হতে পেরে গর্বিত, যিনি কোনও যুদ্ধ শুরু করেননি। যদিও সমর্থকদের ক্যাপিটল হিলে হামলা চালানোয় প্ররোচনার জন্য তিনিই দায়ী। চরম দক্ষিণপন্থী হয়েও ট্রাম্প 7.4 কোটি ভোট পাওয়ায়, ‘ট্রাম্পিজ়ম ’কে মুছে ফেলাটা সহজ হবে না । ট্রাম্প যেরকম নির্লজ্জভাবে মিথ্যে কথা বলেছেন, সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন, তেমনটা আর কোনও প্রেসিডেন্ট করেননি। তিনি আট বছরে দেশকে ঋণমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি চার বছরে ঋণের বোঝার ওপর আরও 8.3 লাখ কোটি ডলার চাপিয়েছেন । বাইডেনের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জই হল একটা পাগল হাতির হানায় বিধ্বস্ত ব্যবস্থাকে ঠিক পথে আনা, এবং সে যা রেখে গেছে, সেই সামাজিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটের উপশম করা ।
ট্রাম্পের শাসনকাল, যা বেশি কথা ও কম কাজের জন্যেই পরিচিত, সেসময় কোভিড প্যানডেমিকের হানা চার লাখ অ্যামেরিকানের জীবন কেড়ে নিয়েছে । কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত অ্যামেরিকান সৈন্যের সংখ্যার প্রায় সমান । একমাত্র নিজে মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরেই ট্রাম্প বুঝতে পারেন যে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর ।
জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন, যে তাঁর শাসনকালের একশো দিনের মধ্যে দশ কোটি অ্যামেরিকান নাগরিককে টিকা দেওয়া হবে। এটাই কার্যত তাঁর ‘মহাযজ্ঞ’। বেকারত্বের হার প্যানডেমিকের আগেই গত 50 বছরের মধ্যে সবথেকে খারাপ জায়গায় পৌঁছেছিল । প্যানডেমিকের পর তা আরও অসহায় অবস্থায় চলে গেছে । শুধুমাত্র ডিসেম্বরেই 1.4 লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, যার জেরে দেখা দিয়েছে সামাজিক সঙ্কট । ভাইস প্রেসিডেন্ট কিছু চমকে দেওয়ার মতো তথ্য প্রকাশ করেছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ছ’টি অ্যামেরিকান পরিবারের একটিকে ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে, দেশের 20 শতাংশ নাগরিকের কাছে বাড়িভাড়া দেওয়ার টাকা নেই, আর একের তিন ভাগ পরিবারের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার অর্থ নেই ।
আরও পড়ুন : আজ গণতন্ত্রের দিন, শপথ নিয়ে দৃপ্ত ঘোষণা বাইডেনের
এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে বাইডেন 1.9 লাখ কোটি ডলার বরাদ্দ করে একটা আপৎকালীন রণকৌশল গ্রহণ করেছেন । যদিও এই পরিকল্পনা তখনই সফল হতে পারে, যদি রিপাবলিকানরাও এগিয়ে এসে সরকারের সঙ্গে হাত মেলায় । বাইডেনের লক্ষ্য, টিকাকরণের মাধ্যমে কোভিডকে পরাস্ত করা এবং যোজনা বরাদ্দের মাধ্যমে অর্থনীতির হাল ফেরানো এবং কর্মসংস্থান তৈরি করা । তাঁকে অ্যামেরিকান সমাজে বৈষম্যেরও মোকাবিলা করতে হবে । তাঁকে বুঝতে হবে, যে গ্রামীন এলাকার মানুষ ও শ্রমজীবীদের মধ্যে ক্ষোভ থেকেই ‘ট্রাম্পিজ়ম’ ইন্ধন পেয়েছিল । যেভাবে সঙ্কটের সময় তৈরি হওয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন দূরদর্শী আব্রাহাম লিঙ্কন ও ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, সেটাই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চালিকাশক্তি হওয়া উচিত । বাইডেন যদি তাঁর প্রাপ্তমনস্কতা ও জ্ঞান দিয়ে মানুষের আকাঙ্খা পূরণ করতে পারেন, একমাত্র তখনই অ্যামেরিকান সুপার পাওয়ার হিসেবে তার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।