কলকাতা, 12 মে: করোনার ছোবলের জোর কমায় জীবন এখন নিউ নর্ম্যাল ৷ অনলাইনের গেরো পেরিয়ে ছন্দ ফিরছে ধীর গতিতে ৷ দীর্ঘ লকডাউন কেড়েছে বহু মানুষের কর্মসংস্থান ৷ স্থবির করেছে শিল্প-সংস্কৃতিকে ৷ সিনেমা, সিরিয়াল, থিয়েটার - তালা পড়েছিল সবেতেই ৷ দিন গুজরান করতে লাইট-সাউন্ড-ক্যামেরায় অভ্যস্ত মানুষেরাও সাময়িক বিরতি নিয়ে যুক্ত হয়েছেন ভিন্ন পেশায় ৷ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতাকেও দেখা গিয়েছে বাজারে বসে মাছ কাটতে ৷ এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি ৷ পরিস্থিতির শিকার এ রকমই এক শিল্পীর গল্প শুনব আজ ৷ জনপ্রিয় বাংলা ছবি 'চিলেকোঠা', 'কাটাকুটি'র পরিচালক প্রেমাংশু রায় (Director Premangshu Roy runs food corner)। লকডাউনের প্রবল ঘায়ে বিধ্বস্ত পরিচালক পেট চালাতে আজ রাস্তার ধারে খুলেছেন ফুড কর্নার ৷ বিক্রি করছেন ফিশ ফ্রাই, চিলি চিকেন ৷ তবে শুটিং ফ্লোরে ফেরার স্বপ্নটা এখনও ছাড়েননি ৷
ভাল গল্প হাতে থাকলেও প্রযোজকের অভাবে ছবি বানানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি । তাঁর নাট্যদল 'স্বপ্নালু' দর্শককে উপহার দিয়েছে 'কালক্রেতা'র মতো জনপ্রিয় নাটক । শুধু পরিচালনা নয়, চিত্রনাট্য, অভিনয় সবেতেই সাবলীল তিনি । বেশ কিছুদিন হল এ হেন প্রেমাংশু রায়ের জীবনকে একেবারে বদলে দিয়েছে আর্থিক অনটন । লকডাউনের সময় হাতে বিশেষ কাজ ছিল না ৷ তাই সংসার চালাতে, ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতে তিনি বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা (Premangshu Roy films)।
বেহালা সরশুনার বাগপোতায় তাঁর বাড়ি । সেখানেই স্ত্রী মৌসুমীকে সঙ্গে নিয়ে খুলেছেন 'সূচক ফুড কর্নার'। চিলি চিকেন, চিকেন পকোড়া, চিকেন ললিপপ, ফিশ ফ্রাই বানাচ্ছেন, বিক্রি করছেন ৷ অনলাইনেও আসছে অর্ডার । নিজে রান্না করতে পারেন না । তাই হাতা-খুন্তির ভার স্ত্রী মৌসুমীর কাঁধে দিয়ে সবজি কাটার কাজটি নিজে করেন প্রেমাংশু ।
ফুড কর্নার চালাচ্ছেন জনপ্রিয় ছবির পরিচালক তাঁর স্ত্রী মৌসুমীর কথায়, "এই কাজে ওর মন নেই । অন্যমনস্ক খুব । এ সব কাজ আগে তো করেনি কখনও । মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত প্রেমাংশু । বাজার আর কাটাকুটির কাজটুকুই করে । বাকিটা আমিই সামলাই । আমি চাই এই কাজ থেকে ও তাড়াতাড়ি বেরোক । আমি দোকান দেখব । ওকে ফ্লোরে দেখতে চাই ।"
আরও পড়ুন:Dev-Rukmini : চোখে চোখে কথা বল... দেব-রুক্মিণীর খুল্লমখুল্লা প্রেম
উল্লেখ্য, প্রেমাংশু রায় কয়েকদিন আগেই ফেসবুকে একটি পোস্ট করে তাঁর জগত থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন ৷ তিনি লেখেন,
"সিদ্ধান্ত" (ইচ্ছে হলে পড়বেন)
আজ বাংলা বছরের শেষ দিনে একটা সিদ্ধান্ত জানাই । আমি আপাতত বাংলা নাট্য জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি । যদিও এটা বড় কোনও খবর নয় । আমি থেকেও বাংলা নাট্য জগতে বিশাল কোনও সৃষ্টি বা উন্নতি করতে পারিনি গত সাতাশ বছরে । তাই আমি নাট্য জগতে থাকলে বা না থাকলে নাট্য জগতের কিছুই আসে যায় না । কিন্ত সত্যি কথা বলতে, আমার এসে যায় । কষ্ট হচ্ছে খুবই । গত সাতাশ বছরের অভ্যাস তো !
কিন্ত কেন নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি ? এই প্রশ্ন দুই একজন করতেই পারেন । তাঁদের জন্য উত্তর দিই । প্রথম কারণ হল, নিজস্ব আর্থিক সমস্যা । দ্বিতীয় কারণ হল, পুরোটাই ব্যক্তিগত, তাই সকলকে বলা যাবে না । আর তৃতীয় কারণ হল, এত বছর নাট্য যাপনের (ভুল বা ঠিক যেটাই হোক) পর বুঝলাম, আমি এখনও মানুষ চিনতে শিখিনি । যদি সাতাশ বছর নাট্য যাপন করে মানুষ চিনতেই না শিখতে পারি, তবে আমার নিজেকে নাট্য কর্মী বা শিল্পী পরিচয় দেওয়াই মানায় না । তবে তার মানে এটা নয় যে, আমার কারও নামে কোনও অভিযোগ আছে । নিজের ছাড়া কারও নামে কোনও অভিযোগ আমার নেই । এই জগতে সকলেই ভালো, আমি ছাড়া ।
তাই যে সকল আমার বন্ধু ও সহকর্মীরা এখনও আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন, যাতে আমি আর কাজ না করতে পারি, তাঁরা ও সব করে ফালতু নিজেদের সময় নষ্ট করবেন না । কারণ, আমি নিজেই সরে গেলাম । আপনারা ভালো মানুষ, ভালো থাকুন, আপনাদের হাত ধরে বাংলা থিয়েটার এগিয়ে যাক ।
তবে প্রথমেই আমি লিখেছি, আমি আপাতত সরে গেলাম নাট্য জগত থেকে, একেবারে চলে যাচ্ছি না । ফিরব তো অবশ্যই । কারণ, অনেককে অনেক উত্তর দেওয়া বাকি, মুখোশ খোলা বাকি এবং সবার উপরে নিজের কিছু স্বপ্নের কাজ করা বাকি । ততদিন আপনারা সানন্দে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে, নোংরা রাজনীতি করে, মিথ্যাচার করে, শিল্পীর কেরিয়ার অমানুষের মতো শেষ করে, চামচাগিরি করে, নাট্য যাপন করতে থাকুন । আমার এখন দেখার ও শোনার সময় ।
ভালো থাকুন সকল নাট্য বন্ধুরা । অগ্রিম শুভ নববর্ষ।"
আরও পড়ুন:Web Series Mahabharat Murders : চিনে নিন কলিযুগের মহাভারতের চরিত্রদের
উল্লেখ্য, 'সিডনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব'-এ পুরষ্কৃত হয়েছিল প্রেমাংশুর 'চিলেকোঠা' । অভিনয় করেছেন ব্রাত্য বসু, ঋত্বিক চক্রবর্তী, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা । এমন একজন প্রতিভাধর পরিচালকের আজকের এই অবস্থার জন্য তা হলে দায়ী কারা ? প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই সামনে এসে দাঁড়ায় । এর জন্য অবশ্য কারওকে সরাসরি দায়ী করেননি প্রেমাংশু । তাঁর কথায়, "আজকাল ঘরে ঘরে পরিচালক কিংবা অভিনেতা । হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে যদি ঢিল ছোড়া হয় যাঁর কাছে পড়বে দেখবেন তিনি হয় একজন পরিচালক নয়তো অভিনেতা । তিনি হয়তো সাইকেল চালাতে পারেন না কিংবা অন্য কাজ পারেন না । কিন্তু অভিনয়টা পারেন আর পারেন সিনেমা বানাতে ।" প্রেমাংশুর এই কথায় তাঁর শ্লেষ স্পষ্ট ৷ যথাযথ পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই এই ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকে বহাল তবিয়তে কাজ করছেন, এটাই বোঝাতে চেয়েছেন পরিচালক ৷
আরও পড়ুন : 'আমার কোনও রং নেই, আমি শিল্পী, যে খারাপ কাজ করে তাঁর বিরুদ্ধেই লিখব'
তিনি আরও বলেন, "এমন নয় যে আমি সিনেমা, থিয়েটারে আর ফিরব না । আমি যে ধরনের বিষয় নিয়ে ছবি বানাতে চাই, তার জন্য প্রযোজক পেলেই ফিরব ফ্লোরে ।"
আনন্দের খবর, তাঁর সঙ্গে কাজের কথা শুরু হয়েছে জনৈক প্রযোজকের । কিন্তু সইসাবুদ হওয়ার আগে তা সংবাদ মাধ্যমকে জানাতে রাজি হননি প্রেমাংশু । খুব শিগগিরই তিনি তাঁর জগতে ফিরুন, দর্শকদের তাঁর সৃষ্টি উপহার দিন, এটাই প্রার্থনা ৷