মালদা, 2 সেপ্টেম্বর : করোনার ধাক্কায় টলমলে দেশের অর্থনীতি । অর্থনীতিবিদদের একাংশের বক্তব্য, এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র কৃষিই । বাংলায় এখন পাটের মরসুম । অনুকূল আবহাওয়ায় পাটের উৎপাদনও বেশ ভাল । গত মরসুমে পাটের ভাল দাম থাকায় মালদার চাষিরা এবার ব্যাপক হারে সোনালি তন্তুর চাষ করেছেন । কিন্তু উৎপাদিত পাট বিক্রি করতেই মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে তাঁদের । এখনও পর্যন্ত নির্ধারিত মূল্যে সরকারিভাবে পাট কেনা শুরু হয়নি । কবে তা শুরু হবে, জানে না কেউ । এই পরিস্থিতিতে পোয়া বারো ফড়েদের । গরিব চাষিদের কাছ থেকে নামমাত্র দামে পাট কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা । অভাবের তাড়নায় তাঁদের কাছে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা । জেলা কৃষি দফতর জানাচ্ছে, পাটচাষিদের এই সমস্যা কয়েক দশকের । বিষয়টি দফতরের তরফে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে ।
কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মালদা জেলার 15টি ব্লকেই কমবেশি পাট চাষ করা হয় । তার মধ্যে উত্তর মালদার ব্লকগুলিতে পাটের চাষ সর্বাধিক । এবার জেলায় 32 হাজার 100 হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে । গতবারের তুলনায় প্রায় আট হাজার হেক্টর বেশি জমিতে পাট চাষ হয়েছে । অনুকূল আবহাওয়া থাকলে সাধারণত প্রতি হেক্টর জমিতে 2.5 মেট্রিক টন পাট উৎপাদিত হয় । কিন্তু এবার পাট চাষের জন্য খুব ভাল আবহাওয়া ছিল । সময়মতো ভাল বৃষ্টিও হয়েছে । তাই এবার হেক্টর প্রতি তিন কুইন্টাল পাট উৎপাদন হওয়ার আশা করা হচ্ছে । বর্তমানে পাট পচানোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে । বেশিরভাগ জমির পাটই ঘরে তুলে ফেলেছেন চাষিরা ।
শেষ পর্যায়ে চাষিরা দ্বিবিধ সমস্যায় পড়েছেন । প্রথমত, মরসুমের একেবারে শেষে পাট পচানোর উপযুক্ত জলাশয় পাচ্ছেন না তাঁরা । ফলে জমি থেকে পাট অনেক দূরে নিয়ে যেতে হচ্ছে । এতে তাঁদের পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে । পাট পচানো কিংবা পাট গাছ থেকে তন্তু বের করার শ্রমিকেরও অভাব দেখা দিয়েছে । সবচেয়ে বড় সমস্যা, উৎপাদিত পাটের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না তাঁরা । করোনার ধাক্কায় বেশিরভাগ চাষির আর্থিক অবস্থা বেহাল । ব্যাঙ্ক অথবা মহাজনি ঋণ নিয়ে পাট চাষ করেছিলেন । প্রতি বিঘা জমিতে পাট চাষের খরচ 12 থেকে 15 হাজার টাকা । ভাল ফলন হলেও বিঘা প্রতি তিন কুইন্টালের বেশি উৎপাদন হয় না । এই অবস্থায় প্রতি কুইন্টাল পাট সাত থেকে আট হাজারে বিক্রি করতে না পারলে তাঁরা চরম সমস্যায় পড়বেন ।
মহম্মদ রিয়াজুল হক বলেন, "এবার পাটের ফলন খুব ভাল । করোনার জন্য আমার পাট চাষ করতে কোনও অসুবিধে হয়নি । কিন্তু এখন পাট পচানোর জায়গা আর প্রয়োজনীয় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না । শ্রমিকের মজুরি অনেক বেড়ে গিয়েছে । এদিকে পাটের দাম পাওয়া যাচ্ছে না । আমাদের শৈলপুরে পাট পচানোর জলাশয় নেই । মহানন্দায় পাট পচাতে গেলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । তাই পাঁচ কিলোমিটার দূরে সাতঘরিয়া গ্রামে এনে পাট পচাতে হয়েছে । এতে খরচটাও বেড়ে গিয়েছে । এদিকে এখন পাটের দাম যাচ্ছে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কুইন্টাল । এই দামে পাট বিক্রি করতে গেলে আমাদের ক্ষতি হয়ে যাবে । এক বিঘা পাট চাষ করতে সব মিলিয়ে 15-16 হাজার টাকা খরচ হয়ে যায় । খুব ভাল ফলন হলেও বিঘা প্রতি তিন কুইন্টাল উৎপাদন হয় । ফলে এই দামে পাট বিক্রি করলে খরচই উঠবে না । সরকার এখনও পাট কেনা শুরু করেনি । ফড়েরাই পাট কিনছে । আমরা চাইছি, সরকার আমাদের কাছ থেকে পাট কিনুক । ফসলের সঠিক দাম না পেলে চাষিরা মরে যাবে । আত্মহত্যা করবে ।"
এনামুল হক বলেন, "এবার আমাদের এলাকায় পাটের ফলন খুব ভাল হয়নি । আড়াই কুইন্টালের বেশি ফলন হয়নি । এদিকে পাটের দামই পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকাররা পাট কিনতে চাইছে না । কারণ তাঁরাও পাট বিক্রি করতে পারছেন না । তবু আমরা তাঁদের কাছে পাট বিক্রি করতে চাইলে তাঁরা প্রতি কুইন্টালে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার বেশি দাম দিতে চাইছে না । আমরা পাট নিয়ে কোথায় যাব, তাও বুঝতে পারছি না । পাটের আঁশ ছাড়ানোর শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না । পাট ছাড়ানোর জন্য সরকারি কোনও ব্যবস্থা নেই । আমি তিন বিঘা পাট চাষ করেছি । পাট জমি থেকে উঠে গিয়েছে । বিক্রি করতে পারিনি । কী করব জানি না । সরকার পাট কিনছে না । ফড়ে ছাড়া আমাদের পাট বিক্রির জায়গা নেই । এদিকে চাষের খরচ অত্যাধিক বেড়ে গিয়েছে । আমরা চাইছি, সরকার পাটের সঠিক দাম নির্ধারণ করুক । এভাবে পাট চাষই করা যাবে না ।"