মালদা, 21 মার্চ : শেষপর্যন্ত সাসপেন্ড করা হল গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রধান সৌগত পালকে। গতকাল কলকাতায় আয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় তাঁকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের কথা সৌগতবাবুকে গতকালই লিখিতভাবে জানিয়ে দেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বিপ্লব গিরি। কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি সৌগতবাবু। ETV ভারতকে তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনের দ্বারস্থ হতে চলেছেন।
ঘটনার সূত্রপাত ১৪ মার্চ রাতে। পরদিন সংবাদমাধ্যমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বাগত সেন বলেন, ১৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে জানান যে রসায়ন বিভাগের এক ছাত্র ব্যাগ ভরতি ফাইল নিয়ে যাচ্ছিলেন। নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে ফাইল দেখাতে বললে তিনি ফাইল দেখিয়ে সেসব নিয়ে ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে চলে যান। ওই বিভাগের এক অধ্যাপকও অত রাতে তাঁর কক্ষে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। ততক্ষণে খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন কয়েকজন অধ্যাপক অধ্যাপিকাও। তাঁরা সবাই দেখেন, দুটি ফাইল ওই অধ্যাপকের ঘরের দরজার কোণে পড়ে রয়েছে। ওই অধ্যাপক একসময় RUSA (রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান)-র আহ্বায়ক ছিলেন। সেই সময় তাঁর কাছে থাকা সমস্ত ফাইল তাঁকে ১৩ মার্চের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেদিনের মধ্যে সব ফাইল জমা দিতে পারবেন না বলে রেজিস্ট্রারকে একটি মেইল করেছিলেন। ঠিক তার পরদিন রাত সাড়ে ১০টার সময় যদি কেউ কোনও ফাইল নিয়ে বেআইনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যায়, তবে তা কাম্য নয়। গোটা ঘটনায় তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানায় জানান। পুলিশের উপস্থিতিতে ওই অধ্যাপকের ঘর থেকে পাওয়া ফাইল দুটি সিল করা হয়। এই ঘটনার তদন্তের জন্য তিনি একটি কমিটিও গঠন করেন।
স্বাগতবাবু সেদিন আরও জানান, উপাচার্য পরিবর্তনের সময় রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে উধাও হয়ে যাওয়া আরও অনেক ফাইল এখনও পাওয়া যায়নি। ১৪ তারিখের ঘটনার সঙ্গে পুরোনো সেই ঘটনার কোনও যোগ রয়েছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখা হবে। তাঁর আশঙ্কা, এখনও পর্যন্ত যে ফাইলগুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেসব RUSA সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার দপ্তরের ফাইল। নাম না করে উপাচার্য রসায়ন বিভাগের যে অধ্যাপকের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন, তিনি ওই বিভাগের প্রধান সৌগত পাল।
গতকাল কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় সৌগতবাবুকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুপুরেই নিজের সাসপেনশনের চিঠি হাতে পেয়ে যান সৌগতবাবু। একইসঙ্গে তাঁকে বিভাগীয় প্রধান পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার একটি আলাদা চিঠি তাঁর হাতে ধরানো হয়েছে। এপ্রসঙ্গে সৌগতবাবু ETV ভারতকে বলেন, "দুপুর আড়াইটে নাগাদ আমি চিঠিটি পেয়েছি। কিন্তু চিঠিটির বক্তব্য আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। তবে চিঠির বয়ান দেখে আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, এটা আমার বিরুদ্ধে একটা গভীর ষড়যন্ত্র। তৈরি নকশা অনুযায়ী আমার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এই ঘটনাটা আমার কাছে প্রত্যাশিত ছিল। তবে যাই হোক না কেন, একজন শিক্ষিত উপাচার্যের কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি। আমার বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত করা হয়েছে, তার সম্পূর্ণই তিনি জানেন। আজকের চিঠিতে আমার বিরুদ্ধে কোনও চার্জের কথাও উল্লেখ করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, ১৪ মার্চ রাতের ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে।"
১৫ মার্চ সৌগতবাবু বলেছিলেন, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। কেন তিনি সেই ত্রাসের শিকার হলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সৌগতবাবু গতকাল বলেন, "আজকের চিঠি এবং তার বয়ান আরও একবার প্রমাণ করেছে এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা ত্রাসের রাজত্ব রয়েছে। ১৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে UG CBCS (চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম) স্কিম নিয়ে আমি এক স্কলারের সঙ্গে কাজ করছিলাম। সন্ধে ৭টা নাগাদ আমি চা খেয়ে বাড়ি চলে আসি। পরে ছাত্র মারফত আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তৈরি করা ছকে আমাকে শিকার করে ফেলা হয়।" কিন্তু আপনাকেই কেন টার্গেট করা হচ্ছে? উত্তরে সৌগতবাবু বলেন, "২০১৫ সালে ভিজ়িটিং সায়েন্টিস্ট হিসাবে আমি লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে দু'বছরের জন্য যাই। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আমি ফিরে আসি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন গোপালচন্দ্র মিশ্র। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে RUSA ও পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যে দুর্নীতি চলছিল, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারতলা ভবনের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। এনিয়ে একাধিক অভিযোগ ও তদন্ত হয়েছিল। সেই সময় আমরা কয়েকজন শিক্ষক এর প্রতিবাদ করেছিলাম। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। তারই প্রতিহিংসার ফল আজকের এই ঘটনা। উপাচার্য পরিবর্তন হলেও আজ যাঁরা স্বাগত সেনের পাশে ঘুরছেন, তাঁরা কারা? সেটা জানতে পারলেই কেন গোপালবাবুর আমলের ঘটনার প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে তার উত্তর মিলে যাবে। এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমি স্বাভাবিকভাবেই আইনের দ্বারস্থ হতে চলেছি। আমার একটাই বক্তব্য, আমার বিরুদ্ধে যে তদন্তই হোক না কেন, তা যেন এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বাইরের কাউকে দিয়ে নিরপেক্ষভাবে করানো হয়। আমি চাই খুব দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত শেষ করে গোটা ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসুক।"
সৌগতবাবু আরও জানান, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার দ্বিতীয় একটি চিঠি দিয়ে তাঁকে রসায়ন বিভাগের প্রধান পদ থেকে সাসপেন্ড করার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ওই চিঠিতে রেজিস্ট্রারের কোনও স্বাক্ষর নেই। তাঁর বক্তব্য, বিভাগীয় প্রধান হিসাবে তাঁকেই সমস্ত ফাইল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে হবে। তিনি নিশ্চয়ই অত বোকা নন, নিজের ঘরে নিজে চুরি করবেন।