মালদা, 26 অগাস্ট : সময় পেরিয়েছে অনেকটা ৷ কোরোনা নিয়ে সচেতনতা প্রচারও বেড়েছে । কিন্তু অযথা কোরোনা রোগীকে হেনস্থার শিকার আজও হতে হচ্ছে । এলাকাবাসীর বাধায় দুই সন্তান নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হল কোরোনা সংক্রমিত মহিলাকে ৷ কোনও প্রত্যন্ত এলাকায় নয়, এই ঘটনা ঘটেছে পুরাতন মালদা পৌর এলাকায় ৷ গোটা বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ ওই মহিলার প্রতিবেশীরা ৷ যদিও ঘটনাটি জানতে পেরে ওই মহিলাকে মালদা শহরের আইসোলেশন সেন্টারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন পুরাতন মালদার পৌর প্রশাসক ৷ গোটা ঘটনা নিয়ে আজ জোর চর্চা শুরু হয়েছে পুরাতন মালদা শহরে ৷
ঘটনাটি ঘটেছে পুরাতন মালদা পৌরসভার 12 নম্বর ওয়ার্ডে ৷ সেখানেই দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন বছর বত্রিশের এক মহিলা ৷ স্বামী প্রায় 9 বছর আগে নিখোঁজ হয়ে গেছেন ৷ সম্প্রতি তাঁর নামে সরকারি বাড়ি বরাদ্দ হয় ৷ তার কাজও শুরু হয়েছে ৷ সেই কারণে কিছুদিন ধরে ওই মহিলা এক পড়শির বারান্দায় বাচ্চাদের নিয়ে বসবাস করছিলেন ৷ তিনি গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন ৷ কয়েকদিন আগে তাঁর জ্বর হয় ৷ মৌলপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার পর জ্বর ঠিকও হয়ে যায় ৷ সোমবার চিকিৎসকরা তাঁর লালারসের নমুনা সংগ্রহ করেন ৷ গতকাল রাতে তার রিপোর্ট পজ়িটিভ এসেছে ৷ সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশকর্মীরা ওই মহিলাকে স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলে আইসোলেশনে রাখার চেষ্টা করেন ৷ কিন্তু ওই স্কুলের আশেপাশে থাকা বাড়ির লোকজন তাতে বাধা দেয় ৷ এদিকে কোরোনা রিপোর্ট পজ়িটিভ আসার পর ওই মহিলা পড়শির বারান্দাতেও থাকতে চাননি ৷ তাই গতকাল রাত থেকে তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে নিজের জায়গায় খোলা আকাশের নীচেই রয়েছেন ৷ পাড়া প্রতিবেশীরা আজ সেখানে একটি ত্রিপল টাঙিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে ৷
আবারও হেনস্থা কোরোনা রোগীকে, এবার মালদায় আরও পড়ুন :কোরোনা গুজবে পরিবারকে হেনস্থা, পাশে ETV ভারত
এই ঘটনায় ওই মহিলার পড়শিরা বেজায় ক্ষুব্ধ ৷ তাঁদের একজন নির্মলা হালদার বলেন, “পৌরসভা থেকে এই মহিলাকে একটি ঘর দেওয়া হয়েছে ৷ যতটা টাকা জুটেছিল, সেই টাকা দিয়ে ঘরের কিছু অংশ তৈরি হয়েছে ৷ থাকার জায়গা না থাকায় মহিলা পাড়ার এক বাসিন্দার বারান্দায় দুই সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ৷ সেই বারান্দায় ঝরঝর করে বৃষ্টির জল পড়ে ৷ ওই মহিলার লালারসে কোরোনা ধরা পড়েছে ৷ এরপর থেকে ওই মহিলা তো দূরের কথা, আমাদেরও কার্যত একঘরে করে দেওয়া হয়েছে ৷ দোকানে আমাদের জিনিস দেওয়া হচ্ছে না ৷ স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশ মহিলাকে একটি স্কুলে আইসোলেশনে রাখার চেষ্টা করে ৷ কিন্তু সেখানকার মানুষজন তাতে বাধা দেয় ৷ তাহলে কি কারোর কোরোনা হতে পারে না ? এখনও পর্যন্ত এলাকার কাউন্সিলরও এখানে আসেননি ৷ আমরা চাই, এই মহিলাকে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক ৷ যেভাবে তিনি গোটা রাত দুটো বাচ্চাকে নিয়ে খোলা আকাশের নীচে রয়েছেন, তা চোখে দেখা যায় না ৷ বন্যা হলেও মানুষকে স্কুলে ঠাঁই দেওয়া হয় ৷ এই মহিলার কোরোনা হয়েছে বলে কি তিনি পচে গেছেন ? এই মহিলার জন্য আমরাও সারা রাত জেগে রয়েছি ৷”
আরও পড়ুন :কোরোনায় হেনস্থা: লড়াই রোগের সঙ্গে, রোগীর সঙ্গে নয়, বলছেন বিশিষ্টরা
এলাকার বিদায়ী কাউন্সিলর শঙ্কু সিন্হা বলেন, “বিষয়টি আমি গতকাল শুনেছি ৷ সরকারি বাড়ির নির্মাণ কাজ চলায় ওই মহিলার বাড়ি ভাঙা হয়েছে ৷ তাঁকে একটি স্কুলে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ৷ কিন্তু সেখানকার মানুষজন তাঁকে স্কুলে রাখতে দেয়নি ৷ আজ সকাল থেকে আমরা ওই মহিলা ও তাঁর দুই সন্তানকে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখার পাশাপাশি তাঁদের খাবারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ৷ কোরোনা নিয়ে আমরা মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি ৷ কিন্তু মানুষ একটা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে ৷ আমি ওই মহিলার যা প্রয়োজন, তা তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি ৷”
বিষয়টি নিয়ে পুরাতন মালদার পৌর প্রশাসক কার্তিক ঘোষ বলেন, “এটা কখনই ঠিক নয় ৷ আমরা পৌরসভার পক্ষ থেকে তাঁকে একটি সরকারি ঘরের ব্যবস্থা করেছি ৷ তাঁর পুরোনো ঘর ভাঙা হয়েছে ৷ তাই তিনি এক পড়শির বাড়িতে রয়েছেন ৷ গত পরশু পৌরসভার পক্ষ থেকে কোরোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয় ৷ ওই মহিলার লালাও সংগ্রহ করা হয়েছিল ৷ তার রিপোর্ট পজ়িটিভ এসেছে ৷ আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেই বাড়িতে তাঁকে আর থাকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ আমরা ওই মহিলাকে তাঁর সন্তান-সহ মালদা শহরের বাগবাড়িতে থাকা সেফ হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি ৷ আমরা লক্ষ্য করে দেখছি, এই পৌর এলাকায় কেউ কোরোনা সংক্রমিত হলে তাঁর পাশ থেকে সবাই সরে যাচ্ছে ৷ সংক্রমিত কিংবা তাঁর পরিবারকে সামাজিক বয়কট করা হচ্ছে ৷ এমনটা যেন কখনও না হয়, সংক্রমিতদের পাশে যেন সবাই দাঁড়ায়, তার জন্য আমি সবার কাছে আবেদন জানাচ্ছি ৷”