কলকাতা, 1 জুলাই : প্রতিদিনই বাড়ছে পেট্রল, ডিজ়েলের দাম । আনলক ওয়ান শুরু হতেই জুনের প্রথম দিক থেকে পেট্রল, ডিজ়েলের দাম বাড়তে থাকে । এমনকী দিল্লিতে পেট্রলের থেকে ডিজ়েলের দাম বেড়ে যায় । আজ দিল্লিতে পেট্রলের দাম লিটারপিছু 80 টাকা 43 পয়সা । ডিজ়েলের দাম 80 টাকা 53 পয়সা । কলকাতায় পেট্রলের দাম 82 টাকা 10 পয়সা, ডিজ়েল 75 টাকা 64 পয়সা । 6 জুন কলকাতায় পেট্রলের দাম 73 টাকা 25 পয়সা ও ডিজ়েলের দাম ছিল 65 টাকা 57 পয়সা । অর্থাৎ শেষ 24 দিনে পেট্রলের দাম বেড়েছে 8 টাকা 85 পয়সা । ডিজ়েলের দাম বেড়েছে 9 টাকা 93 পয়সা । কিন্তু কেন বাড়ছে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম ?
2010 সালে সরকারি ভর্তুকিতে রাশ টানার সূত্র ধরে UPA সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সরকারিভাবে আর জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে না । জ্বালানি বিপণন সংস্থাগুলো প্রতিদিনের অপরিশোধিত তেলের দামের উপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করবে । তারপর থেকে একটু একটু করে পেট্রল এবং ডিজ়েলের দামের উপর থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছে । 2014 সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন NDA সরকার ক্ষমতায় আসার পরও সেই সিদ্ধান্তই বহাল রাখে । তথ্য বলছে, 2008 সালে অপরিশোধিত তেলের দাম সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়েছিল । সেই সময় বিশ্বের বাজারে ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল 132 ডলার। অথচ তখন পেট্রলের দাম 50 টাকা ছাড়ায়নি । তথ্য বলছে, NDA সরকার ক্ষমতায় আসার পর 2014 সালের জুন মাসে আমদানি করা অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি 109 ডলার । সেই সময় কলকাতায় লিটার প্রতি ডিজ়েল ছিল 62 টাকা, আর পেট্রল ছিল 79 টাকা । ওয়েস্ট বেঙ্গল পেট্রল-ডিজ়েল অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুরজিৎ কোলে বলেন, "এই মুহূর্তে বিশ্বের বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি 40 ডলারের আশপাশে রয়েছে । লকডাউনের সময় ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম কমে ছিল আরও অনেকটাই । কিন্তু তখনও ভারতে কমানো হয়নি পেট্রল-ডিজ়েলের দাম । তারপর একটু একটু করে বেড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম 40 ডলারের আশপাশে পৌঁছেছে । কিন্তু এদেশে যেভাবে লাগাতার তেলের দাম বেড়ে চলেছে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ততটাও বাড়েনি । তার পরও কলকাতাবাসীকে পেট্রল 81 টাকা 63 পয়সা ও ডিজ়েল কিনতে হচ্ছে 75 টাকা 20 পয়সা দরে । অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়ছে, এই যুক্তিটা ঠিক নয়।"
গত প্রায় 24 দিন ধরে লাগাতার তেলের দাম বাড়ার ফলে সার্বিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে । এমনিতেই লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়েছেন অনেকে । তার উপর তেলের দাম বাড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঊর্ধ্বমুখী দাম জনগণের উপর রীতিমতো বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে । জ্বালানি বিক্রয়কারী সংস্থাগুলির দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েই তাই প্রশ্ন উঠেছে। সুরজিৎবাবুর অভিযোগ, “সাদা চোখে দেখলে তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু পর্দার পিছনে রয়েছে অন্য গল্প । সেখানে পেট্রলিয়াম মন্ত্রকের অঙ্গুলিহেলনেই সবটা ঠিক হয়।"
পেট্রল-ডিজ়েলের মূল্য নির্ধারণ হয় কীভাবে ?
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সুমন মুখোপাধ্যায় বলেন, বেশকিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে ঠিক হয় পেট্রল-ডিজ়েলের মূল্য । প্রতিদিন সকাল ছটার সময় এই মূল্য নির্ধারিত হয়। তিনি বলেন, “ডায়নামিক ফুয়েল প্রাইস মেথডে ঠিক হয় তেলের দাম। কারণ এটা প্রতিদিন পরিবর্তন হয় । আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দরের উপরই শুধুমাত্র এটা নির্ভর করে না । আরও কয়েকটি বিষয় কাজ করে । প্রথমত, পেট্রল-ডিজ়েলের মূল্য অনেকটাই টাকা এবং ডলারের দামের ওঠানামার উপর নির্ভর করে । মিডল ইস্ট এবং রাশিয়ার মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম নিয়ে একটা লড়াই আছে । যেটা অপরিশোধিত তেলের দামে ক্রাশ ডাউন ঘটায় । কিন্তু সেটা আমাদের দেশকে যে সব সময় খুব একটা সুবিধা দেবে তেমনটা নয় । কারণ আমেরিকার মতো দেশ এই লড়াইয়ের ফায়দা নেওয়ার জন্য বসে থাকে । আর সেই কারণে অনেক সময় অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে । অনেকেই প্রশ্ন করেন তাহলে তার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না কেন ? মনে রাখতে হবে এটা বিভিন্ন রাজ্যে তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র 40% কাজ করে । এর সঙ্গে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের এক্সাইজ় ডিউটি এবং রাজ্য সরকারের VAT । কেন্দ্র এবং রাজ্যের এই ট্যাক্স অপরিশোধিত তেলের দামের থেকে বেশি । তার সঙ্গে রয়েছে ডিলার কমিশন । "
পেট্রল-ডিজ়েলের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির সঠিক কারণটা তবে কী?
সুমনবাবু বলেন, “এটা কিছুই না । অর্থনীতির একটা নিয়ম । কারণ লকডাউন এবং তার পরবর্তী সময়ে পেট্রল-ডিজ়েলের চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে । লকডাউনের আগে যে পরিমাণে পেট্রল-ডিজ়েলের চাহিদা ছিল তা এখন নেই। সেটা দাম বাড়ার একটা বড় কারণ । তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের রেভিনিউ একেবারে তলানিতে । সরকার কোথা থেকে তা আদায় করবে ? প্রোডাকশন ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে । কিন্তু সরকারের সামাজিক প্রকল্প এবং অন্যান্য প্রকল্পে খরচ বেড়েছে । আর সেই কারণে তেলের উপর অতিরিক্ত কর বসানো হয়েছে । একই কথা প্রযোজ্য কোরোনায় ভয়াবহভাবে আক্রান্ত ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রেও । আর সেই কারণে সেই দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের তেলের দামের খুব একটা পার্থক্য নেই । এর মাঝে আবার চিনের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি। কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করতে হচ্ছে।"