কলকাতা, 13 অগাস্ট : টোপ ফেলে বসে আছে শিকারিরা ! শুধু শিকার খাঁচাবন্দী হওয়ার অপেক্ষায় । লকডাউন শেষ হলেই জালে উঠবে শিকার । ঠেকাবে সাধ্য কার ! প্রেমের আবেগে কিশোরী যে নিজেই জালে ধরা দিতে ছটফট করছে । কেউ আবার কাজ চায় পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে বলে। "হতভাগীর" দল জানেও না তাদের জন্য অপেক্ষা করছে লাল এলাকার অন্ধ কুঠুরি। আশঙ্কার এমন অন্ধকারে রক্ষক NGO, পুলিশ, নারী সুরক্ষা কমিশন ৷ যারা সুরক্ষা বর্ম তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে! সংশয় থেকেই যায়। কারণ ঘটনার ঘনঘটা৷ ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান ৷
ঘটনা 1: ছোটো বয়সে বিয়ে হয়েছিল উত্তরার (নাম পরিবর্তিত)। এখন বয়স তিরিশের কোঠায়। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভরা সংসার। বাড়ি উত্তর 24 পরগনার বাদুড়িয়া। স্বামী ছোটোখাটো কাজ করে সংসার চালান । লকডাউনের মাঝে ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে আলাপ সিরাজুলের। সিরাজুল উত্তরপ্রদেশের আজমগরের বাসিন্দা। আনলক পর্ব শুরু হতেই সিরাজুল চলে আসে বারাসতে। সেখানে তাঁদের দেখা হয়। কয়েকদিন পরই উত্তরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় । তাঁর স্বামী থানায় অভিযোগ জানালে উত্তরা সাফ জানায়, নিজের ইচ্ছাতেই সে বাড়ি ছেড়েছে ও পাড়ি দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশে । এরপর পুলিশের আর কিছু করার থাকে না। সম্প্রতি উত্তর 24 পরগনার এক NGO খবর পেয়েছে, উত্তরপ্রদেশের নেই উত্তরা। তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছে প্রেমের ফাঁদ পাতা প্রেমিক ।
ঘটনা 2: মিসড কলে আলাপ ৷ কয়েক মাস আগের ঘটনা ৷ বনগাঁর এক কলেজ ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এক যুবকের । পরিচয় ক্রমশ গাঢ় হয় । পরে সেই যুবকের ডাকে কলেজ ছাত্রী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় । তাঁকে গুজরাতে নিয়ে যাওয়া হয় । এরপর সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন শহরে পাঠিয়ে দেহ ব্যবসা করানো হয় মেয়েটিকে দিয়ে । যদিও পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ।
ঘটনা 3: উত্তর 24 পরগনার বাদুড়িয়ার ৷ বছরে 15-র এক কিশোরী বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। লকডাউন চলাকালীন ঘটনাটি ঘটে। তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল স্বরূপনগরের ইটভাটায় । খবর জানতে পারে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এরপর জানা যায়, বিয়ের নাম করে এক যুবক তাকে নিয়ে গেছিল । ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও চাইল্ড লাইন উদ্যোগী হয়ে পুলিশের সাহায্যে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। জানা গিয়েছে, লকডাউনের কারণে ওই মেয়েটিকে রাখা হয়েছিল স্বরূপনগরে। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকলে তাকে নিয়ে যাওয়া হত পুনেতে। ছক ছিল তেমনই। সেখানেই নামানো হত দেহ ব্যবসায়।
এমন হাজারো ঘটনা এই বাংলার বুকে ঘটেই চলেছে ৷ প্রতিদিন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বহু মেয়ে । তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে মাসাজ পার্লারের কাজে, কোথাও স্বল্প বসনা হয়ে কিংবা নগ্ন হয়ে নাচে ৷ কোথাও আবার সরাসরি দেহ ব্যবসায় নিয়োগ করা হচ্ছে তাদের। নারী পাচার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে?
তা জানার জন্য আরও একটি উদাহরণ- গত সোমবার তেলাঙ্গানার রাচাকোন্ডার পুলিশ 2 যুবতিকে উদ্ধার করে। ঘটনাটি অনলাইন উইম্যান ট্রাফিকিংয়ের। পুলিশ হায়দরাবাদের দিলসুখনগরের এ শিভাকুমার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারও করে। এরপরই জানা যায়, চক্রের মাথার নাম চিন্না । চক্রটি পশ্চিমবঙ্গ এবং মহারাষ্ট্রের নারী পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত। তারা এই দুই রাজ্য থেকে মেয়েদের নিয়ে আসত ছ'মাসের জন্য। রাখত হায়দারাবাদের সাধারণ বসতি এলাকায় । তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুই যুবতিকে উদ্ধার করে পুলিশ । দু'জনেই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক । জানা গিয়েছে, অনলাইনে ওই দুই যুবতির ছবি দিয়ে এসকর্ট সার্ভিস চালাচ্ছিল চিন্না। দুই যুবতিকে উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের বাড়িতে যোগাযোগ করে হায়দরাবাদ পুলিশ।
এইসব ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট, সাম্প্রতিককালে নারী পাচার ও পাচার হওয়া মেয়েদের দেহ ব্যবসার কাজে লাগানোর অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে অনলাইন। লকডাউনে অনলাইনকেই হাতিয়ার করেছে নারী পাচারকারীরা। বারাসত উন্নয়ন প্রস্তুতি নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্পাদকের দাবি, লকডাউন পর্বে বেড়ে গেছে নারী পাচারের সম্ভাবনা । এই দাবিকে সমর্থন করেছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "লকডাউন পর্বে যেহেতু বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে, ফলে সংসার চালানোর উপায় কমে গিয়েছে। সেটাকেই টার্গেট করেছে নারী পাচারকারীরা। আনলক পর্বে সুযোগ পেলেই লকডাউনে সক্রিয় পাচারকারীরা যথেষ্ট সংখ্যক নারী পাচার করবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। তবে আমরাও সতর্ক আছি।"
তথ্য বলছে, দেশের মধ্যে নিখোঁজ মেয়েদের তালিকার উপরের দিকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ন্যাশনাল বিউরো অফ ক্রাইম রেকর্ডস 2019 সালের জুন মাসে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল । সেই রিপোর্ট আতঙ্কিত হওয়ার মতো ৷
2016 সালে মহিলা নিখোঁজের ঘটনায় শীর্ষে ছিল মহারাষ্ট্র। ওই রাজ্য থেকে সে বছর নিখোঁজ হন 28 হাজার 316 জন। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। নিখোঁজের সংখ্যা 24 হাজার 937 জন। তৃতীয় স্থানে ছিল মধ্যপ্রদেশ। নিখোঁজের সংখ্যা 21 হাজার 435।
2017 সালেও শীর্ষে মহারাষ্ট্র। নিখোঁজের সংখ্যা ছিল 29,279। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। নিখোঁজের সংখ্যা ছিল 28,133। তৃতীয় স্থানে যথারীতি মধ্যপ্রদেশ। সে বছর ওই রাজ্য থেকে নিখোঁজ হয় 26 হাজার 587 জন।