পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / city

নারী পাচারে দেশে দ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গ, লকডাউনে সুযোগ সন্ধানী পাচারকারীরা - ভারতে নারী পাচার

2016 থেকেই দেশে নারী পাচারের ঘটনায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাজ্য ৷ অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে মহারাষ্ট্রে ৷ এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের পরেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশ ও বিহার ৷

womwomen traffickingen trafficking
পাচারকারীরা

By

Published : Aug 14, 2020, 4:10 PM IST

কলকাতা, 13 অগাস্ট : টোপ ফেলে বসে আছে শিকারিরা ! শুধু শিকার খাঁচাবন্দী হওয়ার অপেক্ষায় । লকডাউন শেষ হলেই জালে উঠবে শিকার । ঠেকাবে সাধ‍্য কার ! প্রেমের আবেগে কিশোরী যে নিজেই জালে ধরা দিতে ছটফট করছে । কেউ আবার কাজ চায় পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে বলে। "হতভাগীর" দল জানেও না তাদের জন্য অপেক্ষা করছে লাল এলাকার অন্ধ কুঠুরি। আশঙ্কার এমন অন্ধকারে রক্ষক NGO, পুলিশ, নারী সুরক্ষা কমিশন ৷ যারা সুরক্ষা বর্ম তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে! সংশয় থেকেই যায়। কারণ ঘটনার ঘনঘটা৷ ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান ৷

ঘটনা 1: ছোটো বয়সে বিয়ে হয়েছিল উত্তরার (নাম পরিবর্তিত)। এখন বয়স তিরিশের কোঠায়। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভরা সংসার। বাড়ি উত্তর 24 পরগনার বাদুড়িয়া। স্বামী ছোটোখাটো কাজ করে সংসার চালান । লকডাউনের মাঝে ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে আলাপ সিরাজুলের। সিরাজুল উত্তরপ্রদেশের আজমগরের বাসিন্দা। আনলক পর্ব শুরু হতেই সিরাজুল চলে আসে বারাসতে। সেখানে তাঁদের দেখা হয়। কয়েকদিন পরই উত্তরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় । তাঁর স্বামী থানায় অভিযোগ জানালে উত্তরা সাফ জানায়, নিজের ইচ্ছাতেই সে বাড়ি ছেড়েছে ও পাড়ি দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশে । এরপর পুলিশের আর কিছু করার থাকে না। সম্প্রতি উত্তর 24 পরগনার এক NGO খবর পেয়েছে, উত্তরপ্রদেশের নেই উত্তরা। তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছে প্রেমের ফাঁদ পাতা প্রেমিক ।

ঘটনা 2: মিসড কলে আলাপ ৷ কয়েক মাস আগের ঘটনা ৷ বনগাঁর এক কলেজ ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এক যুবকের । পরিচয় ক্রমশ গাঢ় হয় । পরে সেই যুবকের ডাকে কলেজ ছাত্রী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় । তাঁকে গুজরাতে নিয়ে যাওয়া হয় । এরপর সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন শহরে পাঠিয়ে দেহ ব্যবসা করানো হয় মেয়েটিকে দিয়ে । যদিও পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ।

ঘটনা 3: উত্তর 24 পরগনার বাদুড়িয়ার ৷ বছরে 15-র এক কিশোরী বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। লকডাউন চলাকালীন ঘটনাটি ঘটে। তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল স্বরূপনগরের ইটভাটায় । খবর জানতে পারে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এরপর জানা যায়, বিয়ের নাম করে এক যুবক তাকে নিয়ে গেছিল । ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও চাইল্ড লাইন উদ্যোগী হয়ে পুলিশের সাহায্যে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। জানা গিয়েছে, লকডাউনের কারণে ওই মেয়েটিকে রাখা হয়েছিল স্বরূপনগরে। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকলে তাকে নিয়ে যাওয়া হত পুনেতে। ছক ছিল তেমনই। সেখানেই নামানো হত দেহ ব্যবসায়।

এমন হাজারো ঘটনা এই বাংলার বুকে ঘটেই চলেছে ৷ প্রতিদিন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বহু মেয়ে । তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে মাসাজ পার্লারের কাজে, কোথাও স্বল্প বসনা হয়ে কিংবা নগ্ন হয়ে নাচে ৷ কোথাও আবার সরাসরি দেহ ব্যবসায় নিয়োগ করা হচ্ছে তাদের। নারী পাচার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে?

তা জানার জন্য আরও একটি উদাহরণ- গত সোমবার তেলাঙ্গানার রাচাকোন্ডার পুলিশ 2 যুবতিকে উদ্ধার করে। ঘটনাটি অনলাইন উইম‍্যান ট্রাফিকিংয়ের। পুলিশ হায়দরাবাদের দিলসুখনগরের এ শিভাকুমার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারও করে। এরপরই জানা যায়, চক্রের মাথার নাম চিন্না । চক্রটি পশ্চিমবঙ্গ এবং মহারাষ্ট্রের নারী পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত। তারা এই দুই রাজ্য থেকে মেয়েদের নিয়ে আসত ছ'মাসের জন্য। রাখত হায়দারাবাদের সাধারণ বসতি এলাকায় । তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুই যুবতিকে উদ্ধার করে পুলিশ । দু'জনেই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক । জানা গিয়েছে, অনলাইনে ওই দুই যুবতির ছবি দিয়ে এসকর্ট সার্ভিস চালাচ্ছিল চিন্না। দুই যুবতিকে উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের বাড়িতে যোগাযোগ করে হায়দরাবাদ পুলিশ।

এইসব ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট, সাম্প্রতিককালে নারী পাচার ও পাচার হওয়া মেয়েদের দেহ ব্যবসার কাজে লাগানোর অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে অনলাইন। লকডাউনে অনলাইনকেই হাতিয়ার করেছে নারী পাচারকারীরা। বারাসত উন্নয়ন প্রস্তুতি নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্পাদকের দাবি, লকডাউন পর্বে বেড়ে গেছে নারী পাচারের সম্ভাবনা । এই দাবিকে সমর্থন করেছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "লকডাউন পর্বে যেহেতু বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে, ফলে সংসার চালানোর উপায় কমে গিয়েছে। সেটাকেই টার্গেট করেছে নারী পাচারকারীরা। আনলক পর্বে সুযোগ পেলেই লকডাউনে সক্রিয় পাচারকারীরা যথেষ্ট সংখ্যক নারী পাচার করবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। তবে আমরাও সতর্ক আছি।"

দেশে নারী পাচারের পরিসংখ্যান, NCRB-র রিপোর্ট ৷

তথ্য বলছে, দেশের মধ‍্যে নিখোঁজ মেয়েদের তালিকার উপরের দিকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ন্যাশনাল বিউরো অফ ক্রাইম রেকর্ডস 2019 সালের জুন মাসে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল । সেই রিপোর্ট আতঙ্কিত হওয়ার মতো ৷

2016 সালে মহিলা নিখোঁজের ঘটনায় শীর্ষে ছিল মহারাষ্ট্র। ওই রাজ্য থেকে সে বছর নিখোঁজ হন 28 হাজার 316 জন। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। নিখোঁজের সংখ্যা 24 হাজার 937 জন। তৃতীয় স্থানে ছিল মধ্যপ্রদেশ। নিখোঁজের সংখ্যা 21 হাজার 435।

2017 সালেও শীর্ষে মহারাষ্ট্র। নিখোঁজের সংখ্যা ছিল 29,279। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। নিখোঁজের সংখ্যা ছিল 28,133। তৃতীয় স্থানে যথারীতি মধ্যপ্রদেশ। সে বছর ওই রাজ্য থেকে নিখোঁজ হয় 26 হাজার 587 জন।

2018 সালেও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ এবং মধ্যপ্রদেশ। মহারাষ্ট্রে নিখোঁজ 33 হাজার 964 জন, পশ্চিমবঙ্গে 31,299 জন, মধ্যপ্রদেশে 29 হাজার 761 জন।

অর্থাৎ মহিলা নিখোঁজের ঘটনায় ধারাবাহিকভাবে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এইসঙ্গে লক্ষ্যণীয় প্রতিবছর বেড়েছে নিখোঁজ মহিলার সংখ্যা। এরাজ্যের জেলাওয়ারি পরিসংখ্যানও একই কথা বলছে৷

2017 সালে উত্তর 24 পরগনার বারাসত পুলিশ জেলা থেকে সবথেকে বেশি মহিলা নিখোঁজ হয়েছিল । সংখ্যাটা ছিল 2789 । দ্বিতীয় স্থানে কলকাতা। সংখ্যাটা ছিল 2188। তৃতীয় স্থানে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট এলাকা। ওই এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন 1863 জন মহিলা। আবার 2018 সালে কলকাতা উঠে আসে প্রথম স্থানে। সে বছর কলকাতা থেকে নিখোঁজ হন 2584 জন মহিলা। দ্বিতীয় স্থানে ছিল নদিয়া। সে বছর ওই জেলা থেকে 2468 জন মহিলা নিখোঁজ হয়েছিলেন। তৃতীয় স্থানে বারাসাত পুলিশ জেলা। মোট 2 হাজার 236 জন নিখোঁজ হন।

পাচার চক্রের অন্যতম টার্গেট শিশু ও নাবালিকা ৷ দেশে শিশু ও নাবালিকা নিখোঁজের সংখ্যাতত্ত্ব প্রকাশ করেছে NCRB ৷ এই তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ। 2016 সালে নিখোঁজ হয় 8503 জন। 2017 সালে নিখোঁজ হয় 10110 জন। 2018 সালে নিখোঁজ হয় 10038 জন। এক্ষেত্রেও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। 2016 সালে এই রাজ্য থেকে নিখোঁজ হয় 8 হাজার 335 জন। 2017 সালে 8 হাজার 178 জন। 2018 সালে 8 হাজার 205 জন। 2016 এবং 2017 সালে তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিল দিল্লি। ওই দু'বছর সে বছর নিখোঁজের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে 6221 এবং 6454 জন। 2018 সালের তৃতীয় স্থানে উঠে আসে বিহার‌। নিখোঁজের সংখ্যা ছিল 6950।

তবে ন্যাশনাল বিউরো অব ক্রাইম রেকর্ডস জানিয়েছে, সমস্ত নিখোঁজ মহিলা ও নাবালিকা যে পাচারের শিকার তেমনটা নয়। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে, গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়ে, অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতে অনেকে নিজে থেকেই নিখোঁজ হন। অনেকে নিখোঁজ হন গুরুতর অপরাধের শিকার হয়ে। কিন্তু নিখোঁজদের একটা বড় অংশ পাচারের কারণেই নিখোঁজ । 2018 সালে ইউনাইটেড নেশনসের গ্লোবাল রিপোর্টও বলছে, পাচার হওয়া নাবালিকা এবং মহিলাদের একটা বড় অংশকে ব্যবহার করা হয় দেহ ব্যবসার কাজে। পাচার হওয়া মহিলা এবং নাবালিকাদের 35%-কে বিক্রি করে দেওয়া হয় গৃহস্থলীর কাজ-সহ অন্য কাজেও।

বারাসত উন্নয়ন প্রস্তুতির সম্পাদক রঞ্জিত দত্ত বলেন, "দীর্ঘদিন নারী পাচার নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি নিখোঁজদের 90 শতাংশই পাচার হয়ে যায়। তাদের বেশির ভাগকেই কাজে লাগানো হয় দেহ ব্যবসায়।"

নির্দিষ্টভাবে বললে ঠিক কোন কোন কাজে লাগানো হয় পাচার হওয়া নাবালিকা ও মহিলাদের? এ বিষয়ে রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় এবং রঞ্জিতবাবুর বক্তব্য এক। দু'জনেই বলেন, পাচার হওয়া নাবালিকা এবং মহিলাদের লাগানো হয় দেহ ব্যবসায়, বারে ডান্স ও অর্কেস্ট্রা ডান্সে, মাসাজ পার্লারে, বিনা পয়সার পরিচারিকার কাজে, এমনকী অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে বিক্রি করে দেওয়া হয় ৷

এই অবস্থায় নারী পাচার রুখতে কীভাবে কাজ করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ? বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী শশী পাঁজা। প্রশ্ন শুনেই তিনি ফোন কেটে দেন। তবে মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "কমিশন, রাজ্য সরকার ও পুলিশ সবসময় সক্রিয় রয়েছে। NGO-গুলি এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিচ্ছে। একটা বিষয় মনে রাখবেন, পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ড এত বেশি হওয়ার কারণ এখানে সব কেস নথিভুক্ত করা হয় । অনেক রাজ্যে কেস নথিভুক্ত করা হয় না । মহিলাদের উদ্ধারের ক্ষেত্রেও এরাজ্যের পুলিশ ব্যাপকভাবেই সক্রিয়। পাচার হওয়া মেয়েদের বিষয়ে কোনও খোঁজখবর পাওয়া গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেভাবেই অনেক মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে।

লকডাউনে যে নারী পাচার বেড়ে গেছে, দারিদ্রই যে পাচারের অন্যতম কারণ, তাও স্পষ্ট করলেন মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন ৷

তিনি বলেন, "এটা সত্যি যে লকডাউন পরবর্তীতে নারী পাচারের সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়ে গেছে। আমফানের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও নারী পাচার বাড়িয়ে দিতে পারে । আয়লা পরবর্তী দক্ষিণ 24 পরগনা ও উত্তর 24 পরগনায় নারী পাচার বেড়ে গিয়েছিল। কারণটা হল দারিদ্র। সুযোগ নিয়েছিল পাচারকারীরা। চলতি সময়টাকেও সেভাবে ব্যবহার করতে পারে পাচারকারীরা। সেই কারণে মহিলা কমিশনের পক্ষ থেকে পাড়ায় পাড়ায় সিভিক ভলেন্টিয়ারদের কাজে লাগিয়ে নাবালিকা, যুবতি ও মহিলাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য পুলিশকে বলা হয়েছে।"

ABOUT THE AUTHOR

...view details