কলকাতা, 26 সেপ্টেম্বর: একবছর ধরে চলা বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বি-শতবার্ষিকী উদযাপন উৎসবের সমাপ্তি হল আজ । কোরোনা আবহে সর্বসাধারণের জন্য সেই উৎসব ভার্চুয়াল মাধ্যমে সম্প্রচারিত হল । এদিন পণ্ডিত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে বাংলার এই মণীষীকে নিয়ে একটি লাইব্রেরি, আর্কাইভ ও মিউজ়িয়াম তৈরির ঘোষণা করলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় । পাশাপাশি, গত বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে অমিত শাহের মিছিলকে কেন্দ্র করে হওয়া ঝামেলায় বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি ভাঙার প্রসঙ্গ তুলে এনে আবারও নাম না করে BJP-কে তোপ দাগেন শিক্ষামন্ত্রী । জাতীয় শিক্ষানীতিতে বাংলার সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি ।
বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বি-শতবার্ষিকী পূর্তির অনুষ্ঠান থেকে BJP-কে তোপ শিক্ষামন্ত্রীর - বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বি-শত জন্মবার্ষিকী পূর্তির অনুষ্ঠান
"বাংলার ঐতিহ্য, মর্যাদা, সংস্কৃতি, বাঙ্গালির অহংকার, সব দুরমুশ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে । ধর্মান্ধতায় এমন সব সিদ্ধান্ত এঁরা গ্রহণ করছে যা বাংলাকে, বাংলার সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে চাইছে । রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রামমোহন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নজরুল ইসলামকে মুছে ফেলতে চাইছে ।" বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি ভাঙার প্রসঙ্গ তুলে এনে আবারও নাম না করে BJP-কে তোপ দাগেন শিক্ষামন্ত্রী ।
কোরোনা আবহে অন্যান্য বিশেষ দিনগুলির মতোই আজ ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বি-শতবার্ষিকীর পূর্তি ভার্চুয়াল মাধ্যমে উদযাপন করল রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর । সামাজিক দূরত্ব মেনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল বিদ্যাসাগরের কলকাতার বসতবাড়ি তথা বিদ্যাসাগর অ্যাকাডেমিতে । সেখানে শিক্ষা দপ্তরের বিভিন্ন আধিকারিক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাশ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরি-সহ রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষা দপ্তরের সচিব মণীশ জৈন, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মহুয়া দাস, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য, প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অস্থায়ী সভাপতি কার্তিক মান্না, কবি আবুল বাশার সহ আরও অনেক বিশিষ্ট জনেরা উপস্থিত ছিলেন। ভার্চুয়ালি এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শিক্ষাবিদ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি, শুভপ্রসন্নের মতো আরও অনেক বিদ্বজ্জন । শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানের শুরুতেই টেলিফোনের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে বক্তব্য রাখেন মুখ্যমত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যজুড়ে পণ্ডিত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বি-শতবার্ষিকী পূর্তির উৎসব চলছে বিগত এক বছর ধরে। শিক্ষা দপ্তর, রাজ্য সরকার, বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে সারা বছর ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা, আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিদ্যাসাগরের পৈত্রিক বাড়ি বীরসিংহ গ্রামে এই দ্বি-শত বার্ষিকীর উদযাপন শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে। আয়োজিত হয়েছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি বিদ্যাসাগর পুরস্কারে দেওয়া হয়েছিল রাজ্যের বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তিকে। গত বছর বিদ্যাসাগরের জন্মবার্ষিকীতে 36, বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের বাড়িতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিদ্যাসাগর অ্যাকাডেমি । এ ছাড়া, ওইদিন আরও অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল রাজ্য সরকারের তরফে বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে ।
ইশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বি-শতবার্ষিকী উদযাপনের আজ সমাপ্তি অনুষ্ঠান হল । এদিনের অনুষ্ঠান থেকে গত বছর বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার প্রসঙ্গ তুলে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, "বিদ্যাসাগর বাঙালির অহংকার, বাঙালির পথ প্রদর্শক। যে বিদ্যাসাগরকে অন্যতম বাঙালি বলে মনে করা হয়, তাঁর জন্মের দ্বি-শতবর্ষের প্রাক্কালে ধর্মান্ধ এক রাজনৈতিক দলের মদতে তাঁর মূর্তি ভেঙে ফেলা হয় । রাস্তায় ছড়িয়ে থাকে মূর্তির টুকরো । মানব সভ্যতায় এমন অন্ধকার দিন বিরল । বিদ্যাসাগরের প্রতি এই বীভৎস আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর নেতৃত্বে এ-রাজ্যের বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সবাই সেই প্রতিবাদে সামিল হন। খুব দ্রুত সেই স্থানে বিদ্যাসাগরের নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বি-শতবার্ষিকী উপলক্ষে আরও দুটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে । বিদ্যাসাগরের তৈরি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের সংস্কারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে দেওয়া হয় আর্থিক সাহায্য । একইভাবে বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত বা বিদ্যাসাগরের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাতে নতুন রূপে সেজে উঠতে পারে সেদিকেও নজর দিয়েছে আমাদের সরকার । মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এমনই বহুবিধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্মরণ করেছে পণ্ডিত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে । তবে, যতই করা হোক না কেন, ইশ্বরচন্দ্রের কর্মময় জীবনের পাশে তা সবসময় অকিঞ্চিৎকর ।"
নাম না করে BJP-কে আক্রমণ করে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, "আমরা মনটা খারাপ। যখন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পরে এসেছিলাম, তখন কতলোক, জনস্রোত। প্রতিবাদের মিছিল ভেঙে পড়ছে। আমি একটি রাজনৈতিক সভায় ছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আমার সঙ্গে। তিনি বলেন, পার্থদা আপনার বক্তব্য রাখার দরকার নেই। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। দৌড়ে কলেজ স্ট্রিটে চলে যান। আমি সেদিন এসেছিলাম। ভাবা যায় না । এরা শুধু মূর্তি ভাঙছে না । এরা বাংলার ঐতিহ্য, মর্যাদা, সংস্কৃতি, বাঙ্গালির অহংকার, সব দুরমুশ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে । ধর্মান্ধতায় এমন সব সিদ্ধান্ত তাঁরা গ্রহণ করছে যা বাংলাকে, বাংলার সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে চাইছে । রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রামমোহন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নজরুল ইসলামকে মুছে ফেলতে চাইছে । এর বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কণ্ঠস্বর মেলাতে হবে। ভাবতে পারেন ? বাংলা ক্ল্যাসিকাল ল্যাঙ্গুয়েজে নেই । দুই দেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ । বন্দেমাতরম ধ্বনি দিচ্ছেন, সেও বাঙালি । এভাবে কি মুছে দেওয়া যায় বাংলাকে, বাংলার সাহিত্যকে ? তাঁরা ভুলে গেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির ইতিহাস । আজ নতুন করে তাঁরা ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছে । বাংলাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি, যাবেও না । এই বাংলাকে দমানোর রাজনীতি, সাহিত্যের প্রতি আঘাত, বিদ্যাসাগর যে সংস্কৃতি তৈরি করে গেছেন তাঁকে পদদলিত করার চেষ্টা, আমরা তাঁর থেকে যেন বেরিয়ে আসতে পারি ।"
এদিনের অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরকে কেন্দ্র করে একটি গ্রন্থাগার, একটি মিউজ়িয়াম ও একটি আর্কাইভ গড়ার ঘোষণা করেন । তিনি বলেন, "বিদ্যাসাগরের এই বাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে বিদ্যাসাগর অ্যাকাডেমি । এই অ্যাকাডেমির কর্মধারাকে আরও বিস্তারিতভাবে করার লক্ষ্যে আমরা তৈরি করতে চলেছি একটি লাইব্রেরি, একটি আর্কাইভ ও একটি মিউজ়িয়াম । বিদ্যাসাগরের লেখা বই, বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা অজস্র বই ও পত্রিকার এক বিরাট সংগ্রহ হয়ে উঠবে এই গ্রন্থাগারে । পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের লেখা, তাঁর লেখা নানাবিধ চিঠিপত্র, দলিল, নথি সংরক্ষিত থাকবে আর্কাইভে । আর মিউজ়িয়ামে থাকবে বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের সমাহার । ভবিষৎ প্রজন্ম যাতে উৎসাহিত হয় এই মহাপুরুষকে নিয়ে গবেষণা করতে, অনুসরণ করতে চায় তাঁর কর্মময় জীবন, এমন ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সবসময় পাশে থাকবে এই অঙ্গীকার করি ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এই শুভ জন্মদিনে ।"
পাশাপাশি, এদিন নবম শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য একটি নতুন প্রকল্পের ঘোষণা করেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এই শুভ জন্মদিনে বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানকে আরও উন্নতমানের তৈরি করার লক্ষ্যে আমরা একটি প্রকল্প ঘোষণা করছি । নবম শ্রেণির জন্য সায়েন্স অলিম্পিয়াড । নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে দুই বছর ধরে তাদের পড়াশোনা করার লক্ষ্যে এক হাজার টাকা করে আমরা দিয়ে যাব । এটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে আজকে আমরা উৎসর্গ করলাম তাঁর জন্মদিনে । এর যাবতীয় মোডালিটিস শিক্ষা দপ্তর থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে । আজকে আমরা এটি ঘোষণা করলাম । মডালিটিস তৈরি হয়ে গেছে । শীঘ্রই এটি বিজ্ঞাপিত হবে।"