কলকাতা, 1 সেপ্টেম্বর: পুলিশ দিবসে প্রতিশ্রুতি পূরণের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী। ভিডিয়ো কনফারেন্সের পরেই নয়া সাজে পুলিশ ওয়েলফেয়ার ঘোষণা হতে পারে। নেপথ্যে একাধিক ঘটনা।
ঘটনা 1: 19 মে। কলকাতা পুলিশের কমব্যাট ফোর্সের একজন কোরোনায় আক্রান্ত হন। কোয়ারানটিন করা হয় 19 জনকে। বিক্ষোভকারী পুলিশকর্মীদের দাবি ছিল, তাঁদের কোয়ারানটিন করা হয়েছে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলেই (PTS)। আর এখান থেকেই দানা বাধতে শুরু করে অসন্তোষ। সঙ্গে যোগ হয় আরও বেশ কয়েকটি বিষয়। অভিযোগ, কোরোনা মোকাবিলায় কাজ করা পুলিশকর্মীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাচ্ছেন না। অনবরত কাজ করে চলা পুলিশকর্মীরা একদিনের জন্যও ছুটি পাননি লকডাউনের মাঝে। এই ঘটনায় নিয়ে ক্ষোভ দানা বাধতে শুরু করে। যার বিস্ফোরণ হয় সেই রাতে। রীতিমতো লাঠি, বাঁশ হাতে পথে নেমে পড়েন তাঁরা। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ DC-র কাছে অভিযোগ জানাতে যান একদল পুলিশ কর্মী। তারপরেই শুরু হয় পুলিশ বিক্ষোভ। প্রায় 500 পুলিশকর্মী এরপর রাস্তায় নেমে পড়েন। অবরুদ্ধ হয় রাস্তা। অভিযোগ, বিক্ষোভকারী পুলিশকর্মীরা শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত করেন DC কমব্যাটকে। এমনকী পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের অন্দরমহলে নাকি চালানো হয় ভাঙচুর। পরের দিনই নবান্ন যাওয়ার পথে সেখানে ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোনেন অভাব-অভিযোগ। আশ্বাস দেন ব্যবস্থা নেওয়ার।
ঘটনা 2: 25 মে। বছর সাতচল্লিশের কনস্টেবল পরিমল বাবু 24 মে MR বাঙ্গুর হাসপাতালের সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি ইলনেস ওয়ার্ডে ভরতি হন। জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট ছিল তাঁর। তাঁর লালারসের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়ে। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকেই তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। দুপুরে মৃত্যু হয় পরিমল বাবুর। তাঁর মৃত্যুতে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ আনে গড়ফা থানার পুলিশ কর্মীদের একাংশ। তাঁকে আরও আগে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল বলে দাবি ওঠে। এই ঘটনার জেরে গড়ফা খানায় বিক্ষোভ দেখায় বেশকিছু পুলিশ কর্মী এবং সিভিক ভলেন্টিয়ার। তাঁরা থানায় চড়াও হয়। থানার বেশ কিছু জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয় বলে খবর। ঘটনাস্থানে পৌঁছান DC সাউথ সুবারবার্ন সহ সিনিয়র পুলিশ আধিকারিকরা। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ কর্মী। তাঁরাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
ঘটনা 3: 29 মে। চতুর্থ ব্যাটেলিয়ানের এক পুলিশকর্মীর কোরোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। এই ব্যাটেলিয়নের ব্যারাক সল্টলেকের AF ব্লকে। একই সঙ্গে রয়েছে আবাসন। ব্যাটেলিয়ানের এক পুলিশকর্মীর সংক্রমণ ধরা পড়ার পরেই উত্তপ্ত হতে শুরু করে ব্যারাক। অভিযোগ ওঠে সংক্রমিত পুলিশকর্মীর সংস্পর্শে আসা বাহিনী সদস্যদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোয়ারানটিনে না পাঠিয়ে ডিউটি দেওয়া হয়। তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নেই। অথচ ডিউটি করতে হচ্ছে কনটেনমেন্ট জ়োনে। এই কারণেই একের পর এক পুলিশকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। যার বহিঃপ্রকাশ হয় 30 মে রাতে। চতুর্থ ব্যাটেলিয়ানের পুলিশকর্মীরা ব্যারাকের মূল ফটক বন্ধ করে ভাঙচুর শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় পরিবারের সদস্যরাও। সেই সময় কলকাতা পুলিশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ আধিকারিক ঘটনাস্থানে পৌঁছালেও ব্যারাকের ভেতরে ঢুকতে পারেননি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে নামানো হয় RAF। বেশ কিছুক্ষণ পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। সেই ঘটনায় একজন অ্যাসিসটেন্ট পুলিশ কমিশনারকে বদলি করা হয়। ব্যবস্থা নেওয়া হয় পাঁচ পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে। পরে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল এবং গরফা থানার বেশ কয়েকজন পুলিশকর্মীকে বদলি করা হয়। PTS-এ বিক্ষোভের পরের দিন অর্থাৎ আমফান ঝড়ের দিন সকালে নবান্নে যাওয়ার পথে বৃষ্টি মাথায় করে মুখ্যমন্ত্রী সেখানে যান। সরাসরি শোনেন নিচুতলার পুলিশকর্মীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের কথা। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন পুলিশ কর্মীদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা গিয়েছে, সেই ব্যবস্থা নিতে চলেছে রাজ্য সরকার।
সব ঠিক থাকলে আজ থেকে নয়া সাজে কাজ শুরু করবে পুলিশ ওয়েলফেয়ার বোর্ড। 2012 সালে তৈরি হয়েছিল এই বোর্ড। তবে ততটা সক্রিয় ছিল না। আজ থেকে নতুনভাবে তৈরি হবে এই ওয়েলফেয়ার বোর্ড, যা নিচুতলার পুলিশকর্মীদের সুযোগ সুবিধার দিকে নজর দেবে। পুলিশকর্মীদের সম্মান জানাতে আজ পুলিশ দিবসের ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই উপলক্ষে মঙ্গলবার দুপুর তিনটে নাগাদ রাজ্যের সমস্ত সিনিয়র পুলিশ কর্মীদের বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্নে দোতলা, আটতলা এবং 13 তলায় থাকবেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ আধিকারিকরা। রাজ্যের ADG আইন-শৃঙ্খলা, কলকাতার নগরপাল, সহ DG র্যাঙ্কের সব পুলিশ অফিসার থাকবেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। এছাড়াও ভবানী ভবন, বিধান নগর পুলিশ কমিশনারেট, হাওড়া পুলিশ কমিশনারেট, হাওড়া GRP, শিয়ালদা GRP, শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেট, ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট, পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শাসকের দপ্তর, বাঁকুড়া জেলা শাসকের দপ্তর থেকে ভিডিয়ো কনফারেন্সে বৈঠকে যোগ দেবেন সিনিয়র পুলিশ অফিসাররা। আজকের বৈঠক থেকে পুলিশ কর্মীদের জন্য বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করবেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনটাই আশা করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
উল্লেখ্য, রাজ্যে কোরোনা-আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে 18 জন পুলিশ কর্মীর। তালিকায় সব থেকে উপরে রয়েছে কলকাতা পুলিশ। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যে পুলিশকর্মীদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের পরিবারের এক সদস্যকে চাকরি দেওয়ার ঘোষণা আগেই করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ সেই নিয়োগপত্র তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। পুলিশ দিবসে গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গোটা বাহিনী।