কলকাতা, 15 জুলাই : চালকুমড়ো অথবা লাউয়ের মতো দেখতে একটি বড় টিউমার রোগীর চোয়াল ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে মুখের বাইরে । যার জেরে মুখ পুরো বন্ধ । মুখের ভিতর দিয়ে এই টিউমারটি উপরের দিকে চোখের নীচ পর্যন্ত চলে গেছে । অন্যদিকে মুখের পিছন দিয়ে গলার মধ্যে ঢুকে গেছে । পরিস্থিতি এমন যে কোনও সময় রোগীর মৃত্যু হতে পারে । শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বিরল টিউমারটি কেটে বাদ দিলেন NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা ।
হাসপাতালের ENT বিভাগের চিকিৎসক মনোজ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার হয় । বাঁকুড়ার বেলপাহাড়ির কেন্দিয়াশোলের 21 বছরের তনজিৎ সরদার 2 জুলাই এসেছিলেন NRS-এর ENT বিভাগের আউটডোরে । তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এমন বিরল টিউমার দেখে ওই দিনই চিকিৎসকরা তাঁকে ভরতি করিয়ে নেন । চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন টিউমারের জন্য বড়মাপের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন । প্রয়োজন রক্তেরও । শেষপর্যন্ত শনিবার NRS -এ অস্ত্রোপচার হয় ।
অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর অবস্থা কী রকম ছিল ? মনোজবাবু বলেন, "বিশাল বড় একটি টিউমার নিয়ে আমাদের কাছে আসেন রোগী । টিউমারটি মুখের খোলা অংশ সম্পূর্ণ ব্লক করে দিয়েছিল । উপরের চোয়াল ভেঙ্গে টিউমারটি বেরিয়ে এসেছিল । আমাদের চোখের নিচে যে সাইনাস থাকে সেখান থেকে টিউমারটি এসে উপরের চোয়াল সম্পূর্ণ ভেঙে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে । যার ফলে রোগীকে মুখ সব সময় খোলা রাখতে হত । আর এর জন্য তিনি কিছু খেতে পারতেন না । টিউমারের কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণও হত । রোগীকে ভরতি করিয়ে নেওয়ার পরে রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয় । অস্ত্রোপচারটি খুব কঠিন এবং জটিল ছিল । এই ধরনের অস্ত্রোপচারের নাম ম্যাগজিলেক্টমি । অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমার এবং সেটি যে স্থানে ছিল সেই জায়গাটি অর্থাৎ সাইনাস এবং উপরের চোয়াল বাদ দেওয়া হয় ।"
জটিল এবং কঠিন এই অস্ত্রোপচার কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল?
মনোজবাবু বলেন, "ঝুঁকিপূর্ণ বলতে যে কোনও সময় রোগীর মৃত্যু হতে পারত । শুধুমাত্র অস্ত্রোপচারের সময় নয় । অস্ত্রোপচারের আগেও যে কোনও সময় রোগীর মৃত্যু হতে পারত ।" অস্ত্রোপচারের আগে যে অবস্থায় ছিলেন রোগী, তাতে তিনি খেতে পারতেন না । এ কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, "রোগীর মুখ সম্পূর্ণ ব্লক হয়ে গেছিল এই টিউমারের কারণে । যে কোনও সময়ে টিউমারটি গলার ভিতরের দিকে চলে গেলে শ্বাস আটকে যেত । এর ফলে, অস্ত্রোপচারের আগেও যে কোনও সময় এই রোগীর মৃত্যু হতে পারতো। শ্বাসনালী ব্লক হয়ে যেতে পারে এটা মাথায় রেখে শ্বাসনালি বাইপাসের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয় । যাকে বলা হয় টেকিওস্টমি । অর্থাৎ গলায় ফুটো করে একটি টিউবের মাধ্যমে শ্বাসনালিকে বাইপাস করে দেওয়া হয় । এর পরে টিউমারে অস্ত্রোপচার করা হয় ।"
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খুব বেশি দিনের নয়, তিন-চার মাসের মধ্যে টিউমারটি এত বড় হয়ে গেছিল । এই টিউমার ক্যান্সারের টিউমারের মতো । মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এই সময় রোগীকে লিকুইড খাবার দেওয়া হত । কিছুদিন নাকে নল দিয়েও খাওয়ানো হয়েছিল । টিউমার এখন বের করে দেওয়া হয়েছে । রোগী এখন মুখেই খেতে পারবেন । এই ধরনের ক্যান্সার কেন হতে পারে? মনোজবাবু বলেন, "এ দেশে মুখের ক্যান্সার যে সব কারণে হয় তার অন্যতম হল তামাক । যে কোনও উপায়ে তামাকের ব্যবহার তা সে ধূমপান অথবা চিবিয়ে হোক, খৈনি, গুটখা, নস্যি । এই রোগী ধূমপান করতেন । তবে ধূমপানের কারণে এই টিউমার হয়েছে কি না তা বলা সম্ভব নয় ।"
টিউমারটি কীভাবে বাড়ল ? মনোজবাবু বলেন, " টিউমারের উৎপত্তিস্থান সাইনাস । সেখান থেকে টিউমারটি উপরের চোয়ালের মাড়ি ভেদ করে মুখে নেমে এসেছিল, পুরো সামনের দিকে । আমাদের যে তালু থাকে এবং আলজিভ থাকে, সেখান থেকে শুরু করে টিউমারটি পিছনের দিকে গলার ভিতরের দিকে চলে গেছিল । উপরের দিকে চোখের ভিতরে ঢুকে গেছিল । চোখের যে ওয়াল বা হাড় থাকে সেটা ভেঙে নষ্ট করে দিয়েছিল টিউমারটি । চোখের দিক থেকে শুরু করে, মাড়ির দিক থেকে শুরু করে গলার ভিতর পর্যন্ত অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল এই টিউমারটি । দেখতে অনেকটা চালকুমড়ো অথবা লাউয়ের মতো ছিল ।"
মনোজবাবুর নেতৃত্বে টিউমার অস্ত্রোপচারের জন্য চিকিৎসকদের দলে ছিলেন সিদ্ধার্থ দাস ও অর্পিতা মোহান্তি । অ্যানিসথেটিস্ট হিসাবে ছিলেন চিকিৎসক উজ্জয়নী । চিকিৎসক সিদ্ধার্থ দাস বলেন, "অস্ত্রোপচারের জন্য তিন ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে । এতটাই বড় এই টিউমার এবং সেখানে অস্ত্রোপচার এতটাই কঠিন ছিল যে, এই অস্ত্রোপচার শেষ করতে সময় কতটা লাগবে, তা আমরা জানতাম না । এত তাড়াতাড়ি অস্ত্রোপচার আমরা শেষ করতে পেরেছি, এটা আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল ।" কতটা বড় ছিল এই টিউমার ? এই চিকিৎসক বলেন, "10 ইঞ্চি বাই 6 ইঞ্চি মাপের এই টিউমারের ওজন 750 গ্রাম । সব ঠিকঠাক হওয়ার জন্য রোগী বেঁচে গেছেন ।"