পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / city

অনুমতি মিললেও এবছর অনিশ্চিত যাত্রা - অনুমতি মিললেও এখনই শুরু হচ্ছে না যাত্রা

প্রস্তুতি নেই । তাই জানুয়ারি মাসের আগে যাত্রা প্রস্তুত করা বেশিরভাগ দলের পক্ষেই সম্ভব নয় ।

Open Air theater in Bengal
চিৎপুর যাত্রাপাড়ার ছবি

By

Published : Oct 2, 2020, 10:49 PM IST

কলকাতা, 2 অক্টোবর : চৈত্র-বৈশাখই যাত্রা মঞ্চস্থর আদর্শ সময় । COVID-19-এর জেরে সেই সময়েই বন্ধ হয়ে গেছিল যাত্রা । বড় ধাক্কা খেয়েছিল যাত্রা শিল্প । মার্চ মাস থেকে বন্ধ থাকার পর অবশেষে যাত্রার নতুন সিজ়ন শুরুর আগেই মিলল যাত্রা মঞ্চস্থ করার সরকারি অনুমতি । দীর্ঘদিন পর অনুমতি মেলায় একদিকে যেমন আশার আলো দেখছে চিৎপুরের যাত্রাদলগুলি, আবার অন্যদিকে, কোরোনা আবহে চলা পরিস্থিতিতে কত বায়না মিলবে সেই নিয়েই চিন্তায় যাত্রা দলগুলি । কীভাবেই বা গ্রামগঞ্জের মানুষ তাঁদের অ্যাপ‍্যায়ন করবেন? আগের মতো কি গ্রামের স্কুলঘরটি তাঁদের ছেড়ে দেবেন? নিজেদের বাসস্থানে যাত্রাদলের মানুষদের থাকার জায়গা দেবেন তো ? এইসব চিন্তাই কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁদের ।

কোরোনা আবহে মার্চ মাস থেকে বন্ধ হয়ে গেছিল যাত্রা । আনলকের প্রথম পর্যায়ে রথের ব্যস্ততার চিত্রের বদলে চিৎপুর যাত্রাপাড়ায় নজরে এসেছিল শুধুই নিস্তব্ধতা । আসেনি পরবর্তী সিজ়নের জন্য নতুন বায়না । উলটে আগের পাওয়া বায়না বাতিল হয়ে গেছিল । চিৎপুরের এই যাত্রাপাড়ায় প্রায় 40টি যাত্রাদল রয়েছে । দলগুলির সঙ্গে প্রযোজক থেকে শুরু করে, শিল্পী, সাজঘরের লোক-সহ সরাসরি যুক্ত প্রায় দু'হাজার জন মানুষ । প্রত্যেকেরই রুটি-রুজিতে টান পড়েছিল এই সময়ে । অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 1 অক্টোবর থেকে যাত্রা চালু করার অনুমতি দেওয়ায় আশার আলো দেখছে চিৎপুর যাত্রাপাড়া ।

রাজলক্ষ্মী অপেরা, শুভলক্ষ্মী অপেরা, নাগমাতা যাত্রাদলের প্রযোজক অশোক দাস বলেন, "1 অক্টোবর থেকে মুখ্যমন্ত্রী যাত্রা করার অনুমতি দিলেন । আমরা তো প্রস্তুত ছিলাম না । হঠাৎ করে এই রকম একটা খবর আসল আমাদের কাছে । আমরা খুবই আশাবাদী । মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে, যাত্রা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে । আমরাও সেই আশায় আছি । আমরাও অফিস খুলব । প্রস্তুতি নেব যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা মাঠে বেরোতে পারি । পৌঁছাতে পারি দর্শকদের সামনে । একটা নাটক প্রস্তুত করতে তো সময় লাগে । আজকে বললে তো কালকে মাঠে যেতে পারি না । একটা দলের সঙ্গে শিল্পী, টেকনিশিয়ান, আলো, মিউজ়িক সব মিলিয়ে মোট 40-42 জন থাকেন । তাঁরা তো বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন । তাঁদের খবর দেওয়া হবে । তাঁরাও প্রস্তুত হবেন আসার জন্য । আমাদের স্ক্রিপ্ট লেখা হবে, রিহার্সাল হবে, মাঠে বেরোনো হবে । একটু সময় লাগবে । যাত্রা তো কখনও হারিয়ে যাবে না । গ্রামাঞ্চলে বিনোদন বলতে যাত্রাই । যাত্রা তার পুরানো জায়গায় আবার ফিরে আসবে । এই বাধাবিঘ্ন, দুর্যোগ, ভাইরাস সব উপেক্ষা করে যাত্রা আবার তার জায়গায় ফিরে আসবে, আমরা সেই আশা নিয়েই আছি ।"

জানুয়ারির আগে পুরোদমে যাত্রা শুরু হওয়ায় অনিশ্চয়তা

আশায় বুক বাঁধলেও দুর্গাপুজোর মধ্যে যাত্রা মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতিতে অনেক বাধা রয়েছে । সেইসব বাধা অতিক্রম করা বেশিরভাগ দলের পক্ষেই সম্ভব নয় । যাত্রার তিনটি সংগঠন রয়েছে । পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলন, পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী যাত্রা প্রহরী, কলকাতা যাত্রা কর্মী ইউনিয়ন । মালিক শিল্পী ও যাত্রার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের এই তিনটি সংগঠনের মঙ্গলবার ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয় । সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কোনও প্রযোজক যদি পুজোর মধ্যে নাটক মঞ্চস্থ করতে পারে তা করবেন । কিন্তু, জানুয়ারি মাসের আগে যাত্রা প্রস্তুত করা বেশিরভাগের পক্ষেই সম্ভব নয় । তাই বৈঠকে অধিকাংশ মত দিয়েছেন, জানুয়ারি মাসে প্রস্তুতি নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যাত্রা মঞ্চস্থ করা হবে ।

আরও পড়ুন : মুক্তমঞ্চে পারফর্ম করার অনুমতি দিল সরকার, কী বলছে যাত্রাজগৎ ?

সত‍্যনারায়ণ অপেরার পরিচালক রাম কুণ্ডু বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা করেছেন যে, 1 অক্টোবর থেকে আমরা যাত্রা করতে পারি । কিন্তু, এই অবস্থায় তো আমাদের সবকিছু গোছানো নেই । কারণ, রথ থেকেই আমাদের শুরুটা হয়, শিল্পী নেওয়া, নাটক নেওয়া, রিহার্সাল রুম নেওয়া, রিহার্সাল দেওয়া । সব কিছু ঠিক থাকলেই যাত্রা মঞ্চস্থ করা যায় । কিন্তু এই মুহূর্তে অনুমতি দিলেও সকলে হয়ত পুজোর মধ্যে নাটক তৈরি করতে পারবে না । তার জন্য আমাদের সময় লাগবে । যাত্রা মঞ্চস্থ করার আগে একটা প্রস্তুতিপর্ব আছে । কেউ 20 দিন, কেউ 25 দিন, 15 দিন নাটকের রিহার্সাল দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য প্রস্তুত করে । সেটার জন্য তো সময় পাইনি । পুজোর আর কয়েকদিন বাকি । এই বাকি 15-20 দিনের মধ্যে প্রস্তুত করা খুবই মুসকিল।"

অশোক দাস বলেন, "পুজো থেকেই আমাদের সিজ়নটা শুরু হয় । এবার তো সেটা আমরা আশা করব না । আমরা চেষ্টা করব পুজোর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাঠে বেরোতে । যাত্রা তো সারা বছরই চলে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত । পুজো থেকে শুরু হয় । যাঁরা পুজো উদ্যোক্তা তাঁরাও তো ভাবেননি পুজোটা করতে পারবেন কি না । তাঁরাও পুজোটা করতে পারছেন যখন, সব কিছু যখন খুলবে, তখন এটাও তার সঙ্গে খুলবে । হয়ত একটু দেরিতে হলেও হবে । তবে আমরা আশাবাদী দেরিতে হলেও যাত্রাটা ভালো জায়গায় পৌঁছাবে । প্রস্তুতি নিচ্ছি সেটা এখনই বলা যাবে না । আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রোডাকশন রেডি করার চেষ্টা করছি।"

আরও পড়ুন : 1 অক্টোবর থেকে চালু প্রেক্ষাগৃহ, হবে যাত্রা-নাটকও; জানালেন মুখ্যমন্ত্রী

অগ্রগামী এবং আকাশবাণী যাত্রা সংস্থার পরিচালক প্রশান্ত কুমার সাহা বলেন, "রথযাত্রার থেকে আমাদের বায়নার প্রস্তুতিটা হয়। দল গঠন থেকে শুরু করে, পালার নাম থেকে শুরু করে সবকিছুই হয়। কিন্তু, COVID-19-এর জন্য এবার সেটা সম্ভব হয়নি। মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুরোটাই বন্ধ। হঠাৎ পয়লা অক্টোবর থেকে যাত্রা খুলে দেওয়ার অনুমতি হল। কিন্তু, পয়লা তারিখ থেকে যে খোলা হয়েছে তারপরে আমরা যে পুজোয় শো করব, তারমধ্যে দিন খুব কম। একটা নাটকের রিহার্সাল 30 থেকে 35 দিন ধরে হয়। দিন কমে গেছে। ফলে, রিহার্সাল করার সময় যে কমে গেল সেটা তো পরিষ্কার। এতো কম সময়ের মধ্যে রিহার্সালের করাও মুশকিল।। আমরা চেষ্টা করছি যেহেতু অনুমতি দিয়েছেন, কী করে ডবল রিহার্সাল দিয়ে যদি কিছু করা যায়। সেই হিসেবেই আমরা এগোচ্ছি। নতুন নামও ঠিক করতে হবে, শিল্পী সবার হয়ত কালেকশনও হয়নি। দুই একজন মালিক কালেকশন করে থাকলেও তাঁরা টপ শিল্পী। এরপরে মিউজিশিয়ান, অন‍্যান‍্য কর্মী রয়েছেন। কোরোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই এখন আসতে চাইছেন না । চেষ্টা করছি যদি দুর্গাপুজোর শো করা যায় । যদি দুর্গাপুজোতেও না হয় তাহলে অন্তত কালীপুজো থেকে যাতে লাগাতার শো করতে পারি তার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব ।"

তবে, যাত্রার আদর্শ সময় অর্থাৎ, চৈত্র-বৈশাখ মাসে বন্ধ থাকায় এমনিতেই বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল যাত্রা দলগুলিকে । পুজোর ব‍্যবসাও মার খেয়ে যাওয়ায় সেই ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল বলে জানাচ্ছেন তাঁরা । রাম কুণ্ডু বলেন, "এবার পুজোর ব্যবসাটা পুরোপুরি মার খেয়ে গেল । কোটি টাকার উপর ক্ষতি হবে । 35-40 টা দল আছে এখানে । আশ্বিন-কার্তিক মাসে যদি 40 পালা করেও শো হত, তাহলে বিশাল ক্ষতি হত না ।"

অশোক দাস বলেন, "সবাই আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত । যখন পিক টাইম ছিল তখনই যাত্রা বন্ধ হয়ে গেছিল । একদম সিজ়নে, চৈত্র মাসের শুরুতেই বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রা জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলে । চৈত্র-বৈশাখে আমরা 28 দিনের শো করি । হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের যে টাকা লাগিয়েছিলাম, তা আমরা ফেরত পাইনি । যাত্রা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । এবার দেখা যাক । এবার তো এমনিই ক্ষতির মধ্যে দিয়ে চলছে । তাও যদি শুরু করা যায়, বেরোতে পারি, এই আশা নিয়েই আছি ।"

যদিও, প্রস্তুতির বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তার সঙ্গে অন্য একটি দুশ্চিন্তাও রয়েছে যাত্রা দলগুলির মধ্যে । তা হল, গ্রামগঞ্জের মানুষরা যাত্রাদলের লোকেদের স্কুলবাড়িতে থাকার জায়গা করে দিতেন, নিজের বাড়িতে রাখতেন, তাঁরা এই কোরোনা আবহে শহর থেকে যাওয়া যাত্রাদলের লোকেদের সঙ্গে কেমন ব‍্যবহার করবেন? সেই চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে যাত্রা দলগুলির মাথায় ।

প্রশান্ত কুমার সাহা বলেন, "আমরা প্রস্তুতি নিয়ে শো-টা যে করতে যাব সেটা নিয়েও চিন্তা করতে হচ্ছে আমাদের। যাত্রা মঞ্চস্থ করার অনুমতি দিয়ে পেয়েছি । কিন্তু, শো করতে গিয়ে গ্রামে গ্রামে COVID-19 নিয়ে যেভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে সেখানে আমাদের কি ঠিক মতো থাকতে দেবে? কোনও জায়গায় গেলাম, আগে স্কুলবাড়িতে থাকতে দিত, এবার হয়ত বলল স্কুলবাড়ি দেব না । আগে বাসাতেও থাকতে দিত । প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে আমাদের থাকার জায়গা দিত । এখন কী হবে, এগুলো নিয়েই আমরা চিন্তাভাবনা করছি । "

এখনও পর্যন্ত বায়না প্রায় হয়নি বললেই চলে । এখন এই পরিস্থিতি আগামী দিনে কোনদিকে গড়ায় সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে চিৎপুর যাত্রাপাড়া ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details