কলকাতা, 14 জুলাই : মৃত দুই রোগীর পরিজনদের অভিযোগ, চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে তাঁদের প্রিয়জনদের মৃত্যু হয়েছে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । অথচ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, দুই রোগীকেই মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল । মৃত ওই দুই রোগী COVID-19-এ আক্রান্ত ছিলেন কি না, টেস্ট না হওয়ার কারণে তা জানা যায়নি । যার জেরে, টারশিয়ারি লেভেলের এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে COVID-19 হয়নি এমন রোগীকে কেন রেফার করা হচ্ছে, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন ।
মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল রোগীদের, দাবি কলকাতা মেডিকেল কর্তৃপক্ষের
সোমবার যে দুই রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠেছে, সেই দুই রোগীকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল । জানাল কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৷
কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ইছাপুরের বাসিন্দা 18 বছরের এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় গত শনিবার চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠেছে । কামারহাটির ESI হাসপাতাল, বেসরকারি একটি নার্সিংহোম, কলেজ অফ মেডিসিন ও সাগর দত্ত হাসপাতাল ঘুরে গত শুক্রবার ওই যুবককে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আনা হয়েছিল । পরিজনদের অভিযোগ, দীর্ঘ সময় এই ভরতি না করিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছিল ৷ এমনকি তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসাও শুরু করা হয়নি । অবশেষে ভরতি নেওয়া হলেও, গত শুক্রবার রাতেই যুবকের মৃত্যু হয় । এই রোগীর ব্লাড সুগার অনেক বেড়ে গেছিল । মৃত এই রোগী COVID-19-এ আক্রান্ত ছিলেন বলে জানিয়েছিল এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চিকিৎসায় অবহেলায় গতকাল অন্য আরও দুই রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠল কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । এই দুই রোগীর মধ্যে একজন দক্ষিণ 24 পরগনার জয়নগরের বাসিন্দা । জানা গিয়েছে, 26 বছরের এই রোগীর নাম অশোক রুইদাস । পরিজনরা জানিয়েছেন, টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিলেন এই যুবক । দক্ষিণ বারাসতের একটি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে । শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সোমবার সকালে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় SSKM হাসপাতালে । মৃত এই রোগীর পরিজনদের অভিযোগ, SSKM হাসপাতালে এই রোগীকে ভরতি না নিয়ে রেফার করে দেওয়া হয় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে । এরপর শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল থেকে এই রোগীকে ফের রেফার করে দেওয়া হয় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল থেকে যে অ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে এই রোগীকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানো হয়, সেই অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছিল না বলেও পরিজনদের অভিযোগ ৷ অক্সিজেনের অভাবেই ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে । জানা গেছে, এই রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, জ্বর-ও ছিল । কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে ভরতির প্রক্রিয়া চলাকালীন স্ট্রেচারেই তাঁর মৃত্যু হয় ।
এই রোগীর মৃত্যুর পরে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলার পাশাপাশি পরিজনরা বারবার জানাতে থাকেন, এই রোগীর COVID-19 হয়নি, টাইফয়েড হয়েছিল । দ্রুত অন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে হাসপাতাল থেকে রোগীর মৃতদেহ তাঁরা নিয়ে চলে যান । এই ঘটনায় SSKM হাসপাতালের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, এই হাসপাতালের ফিভার ক্লিনিক রয়েছে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে । কারণ, SSKM হাসপাতালের অধীনে রয়েছে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল । তাই এই রোগীকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের ফিভার ক্লিনিকে পাঠানো হয়েছিল। রোগীকে যদি COVID-19-এ আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হয় এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা যদি আশঙ্কাজনক থাকে, তাহলে এমন রোগীকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রেফার করা হয় । রোগীর শারীরিক অবস্থা যদি স্থিতিশীল থাকে, সে ক্ষেত্রে রোগীকে রেফার করা হয় চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে (নিউ টাউনের সেকেন্ড ক্যাম্পাস) । এর জন্য হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয় । এই রোগীকেও অ্যাম্বুলেন্সে করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল ।
কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সোমবার অন্য আরও এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠেছে । জানা গেছে এই রোগীর নাম লক্ষ্মী সাউ । ষাটোর্ধ্ব এই রোগী বহরমপুরের বাসিন্দা ছিলেন । কিছু দিন আগে তিনি কলকাতায় আসেন । তাঁর পেটে ব্যথা হচ্ছিল । পা ফুলে গেছিল । তিনি জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন বলেও জানা গেছে । কলকাতায় পোস্তা এলাকায় থাকতেন । এই রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সোমবার তাঁকে একটি সাইকেল ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে আসা হয় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছু সময়ের মধ্যেই এই রোগীর মৃত্যু হয় । এই ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন পরিজনরা । মৃত ওই রোগী COVID-19-এ আক্রান্ত ছিলেন কি না, টেস্ট না হওয়ার কারণে তা জানা যায়নি । এই দুই রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, "টারশিয়ারি লেভেলের COVID হাসপাতাল হিসাবে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে COVID-19 রোগীদের রেফার করার কথা । অথচ এই হাসপাতালে নন-COVID-19 রোগীদেরও রেফার করা হচ্ছে ।"
COVID-19 রোগীদের পাশাপাশি কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাতে নন-COVID-19 রোগীদের জন্যেও চিকিৎসা পরিষেবা চালু করা হয়, তার দাবিতে 1 জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এখানকার জুনিয়র ডাক্তাররা । এই আন্দোলনের জেরে হাসপাতালের আউটডোরে এখন নন-COVID-19 রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা ফের চালু করা হয়েছে । তবে এখানকার ইমারজেন্সিতে এখনও নন-COVID-19 রোগীদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা শুরু করা হয়নি । সোমবার দুই নন-COVID-19 রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে জানানো হয়েছে, দ্রুত যাতে এখানকার ইমারজেন্সিতে নন-COVID-19 রোগীদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা চালু করা যায়, তাঁরা তার দাবি জানাচ্ছেন ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, সোমবার যে দুই রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠেছে, সেই দুই রোগীকে মৃত অবস্থায় এই হাসপাতালে আনা হয়েছিল । এর পাশাপাশি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, মুমূর্ষু কোনও রোগীকে এই হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে আসা হলে, ওই রোগী COVID-19-এ আক্রান্ত হয়েছেন কি না, তা না দেখেই তাঁর চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয়। এই কারণে এখানকার গাইনি বিভাগে সোমবার এক প্রসূতিকে ভরতি করানো হয়েছে, যিনি COVID-19-এ আক্রান্ত নন।
এই দুই রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় সোমবার কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে জানানো হয়েছে, প্রতিটি হাসপাতালেই যাতে COVID-19 এবং নন-COVID-19 রোগীদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা চালু থাকে, সেই দাবি-ই তাঁরা জানিয়ে আসছেন । প্রতিটি হাসপাতালে যদি COVID-19 এবং নন-COVID-19 রোগীদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা চালু থাকে তাহলে কোনও রোগীকে এ-ভাবে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হবে না । অথচ, এমন ব্যবস্থা চালু না থাকার কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে রোগীকে যখন কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে, তখন ওই রোগীর শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয়ে যাচ্ছে যে, রোগীকে বাঁচানোর জন্য খুব বেশি সময় পাচ্ছেন না চিকিৎসকরা । এই বিষয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয়কুমার চক্রবর্তীর বক্তব্য জানতে চেয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় । তবে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি ।