কলকাতা,28 সেপ্টেম্বর:2014 সালের 7 মার্চ। কলকাতার ঐতিহাসিক টাউন (Historical Town Hall of Kolkata) হলে স্টেট ব্যাঙ্কের (State Bank Of India) বিশেষ সম্মেলন। আর সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে আসছেন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারপার্সন। ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক থেকে স্টেট ব্যাঙ্কের উত্তরনের মাঝে কেটে গিয়েছে দুশো বছর। কিন্তু ব্যাঙ্কের সর্বোচ্চ চেয়ারে একজন মহিলার অধিষ্ঠান কোনও দিন হয়নি। ফলে তার বক্তব্য শুনতে আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। উপস্থিত শ্রোতার তিলধারণের জায়গা ছিল না সেদিনের টাউন হলে। কলকাতার এই টাউন হল বহু গুনীজনের সংবর্ধনার সাক্ষী। কিন্তু সাত মার্চের বিকেলটা অন্যরকম। সৌজন্য বঙ্গতনয়া অরুন্ধতী ভট্টাচার্য (Arundhuti Bhattacharya) ।
ব্যবসা- বাণিজ্য বিষয়টির সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক তেমন প্রেমের নয় । অন্তত গত একশো বছরের মধ্যে তো নয়ই । এখন বাঙালি চাকরিতেই বেশি অভ্যস্ত । বিশেষ করে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে দারুণ সফল বঙ্গ তনয়ার সন্ধান পাওয়া অসম্ভব না হলেও কঠিন । কিন্তু আজ যাঁর কথা হচ্ছে তিনি নিজে ব্যবসা করেন না ঠিকই কিন্তু গোটা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাঁর প্রায় একছত্র প্রভাব ছিল কয়েক বছর আগে পর্যন্ত । শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি কার্যত এরকম হয়ে উঠেছিল যে টাকার নোটে তাঁর সই দেখার সৌভাগ্য় হত 140 কোটির দেশের । সেটা হয়নি । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (Reserve Bank of India) গর্ভনর হতে না পারলেও অরুন্ধতী ভট্টাচার্য পৌঁছেছিলেন স্টেটব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় পদে । হ্যাঁ প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র মহিলা হিসেবে এই কৃতীত্ব অর্জন করেছেন আধুনিক এই দশভূজা । শুরুতেই তাঁর বিষয়ে আরও একটা খবর দিয়ে রাখা দরকার । 2016 সালে ফোর্বস পত্রিকা তাঁকে তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী 25 কর্ণধারের তালিকায় স্থান দিয়েছিল ।
আরও পড়ুন: ফ্রম চাকদা টু লর্ডস ! 'এক্সপ্রেস' গতিতে ছোটা ঝুলন আক্ষরিক অর্থেই দশভূজা
1956 সালের 18 মার্চ কলকাতায় জন্ম হয় অরুন্ধতীর । তবে তাঁর বড় হয়ে ওঠা বোকারোতে । বাবা প্রদ্যুৎ মুখোপাধ্যায় চাকরি করতেন বোকারে স্টিল প্ল্যান্টে । মা কল্যাণী ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক । প্রাথমিক পড়াশুনো বোকারোর সেন্ট জেভিয়ার্সে । তারপর ইংলিশ পড়তে আসেন কলকাতার লেডি ব্রেবর্ন কলেজে । পরে ভর্তি হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে । স্বামী প্রীতিময় পড়াতেন আইআইটি খড়গপুরে ।
কর্মজীবন শুরুর আগে অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের স্বপ্ন ছিল ইংরেজী নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার। কিন্তু বিধাতা অন্য কিছু লিখে রেখেছিলেন। টাউন হলের ওই সভায় অরুন্ধতী সেই ইতিহাসের খানিকটা তুলে ধরেছিলেন । তাঁর কথায়, “সেসময় আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। টিউশনি করতে যেতে হত নিউ আলিপুর অঞ্চলে। ফেরার সময় নিউ আলিপুর স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে থেকে বাস ধরতাম। আর বাসের অপেক্ষা করার ফাঁকে ব্যাঙ্ককর্মীদের আচরন চোখে পড়ত। ভাবতাম সন্ধ্যা সাতটার সময়ও কোন আকর্ষণে ব্যাঙ্কের ওই কর্মীরা চেয়ারে বসে কাজ করে চলেছেন। এত কাজের অনুপ্রেরণা আসে কোথা থেকে ? দেখতে দেখতেই ঠিক করেছিলাম চাকরি করতে হলে স্টেট ব্যাঙ্কেই করতে হবে।” যেমন ভাবা তেমনই কাজ। মাত্র ২২ বছর বয়সে স্টেট ব্যাঙ্ক প্রবেশনারী অফিসার পরীক্ষায় পাশ করে ঢুকে পড়েছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কিং পরিষেবার অঙ্গনে। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় তার প্রথম পোষ্টিং হয়েছিল ওই আলিপুর স্টেট ব্যাঙ্কেই।
আরও পড়ুন: অভিনেত্রী থেকে পরিচালক, উত্তম-সৌমিত্রর নায়িকাও, মেমসাহেবের শুরু আছে শেষ নেই
1977 সালে পিও হিসেবে স্টেটব্যাঙ্কে প্রবেশ অরুন্ধতীর । এরপরের সাড়ে তিন দশক ওই ব্যাঙ্কের একাধিক বড় দায়িত্ব সামলেছেন । কখনও ছিলেন বৈদেশিক মুদ্রা বিভাগে, কখনও আবার মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগে। তাছাড়া ব্যাঙ্কের রিটেল ব্যবসা সংক্রান্ত বিভাগও দেখতেন একসময় । ব্যাঙ্কের নিউ ইর্য়কের দপ্তরে বসে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। তাঁর হাত ধরেই দিনের আলো দেখেছে এসবিআইয়ের জেনারেল লাইফ ইনসুরেন্স । অনেকের মতে তাঁর নেতৃত্বে একাধিক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসবিআই । এর মধ্যে 2 বছরের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ঘোষণার বিষয়টিও আছে । তাছাড়া ব্যাঙ্কের সমস্ত মহিলা কর্মীদের সার্ভিক্যাল ক্যানসারের হাত থেকে রক্ষা করতে বিশেষ ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেন তিনি । 2013 সালের 30 সেপ্টেম্বর এসবিআইয়ের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন প্রতীপ চৌধুরির জায়গায় তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় । আরও পরে 2016-17 সাল নাগাদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সম্ভাব্য গভর্নর হিসেবে তাঁর নাম নিয়ে চর্চা হয়েছিল । কিন্তু শেষমেশ তা হয়ে ওঠেনি ।
আরও পড়ুন: কলকাতার দুর্গাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, নেপথ্যে রয়েছেন আরও এক 'দুর্গা'
ফর্চুন পত্রিকা তাঁকে পাঁচশোটি ভারতীয় কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত করেছিল। 2018 সালে পেয়েছিলেন এই মহাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মান। 2017 সালে অবসর নেওয়ার পরে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমণ্ত্রন পেয়েছিলেন। একজন নারী হিসেবে প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি বুঝিয়েছেন অধ্যাবসায় আর মনের জোর থাকলে কাউকে আটকে রাখা যায় না। এখনকার পরিভাষায় বললে,"দাবায় রাখতে পারবা না...' । তাই আজকের দশভূজায় অরুন্ধতী ভট্টাচার্য সব দিক থেকেই ওম্যান অব সাবস্টেন্স।