কলকাতা, 18 জুন: লকডাউন থেকে আনলক পর্ব । কোরোনার বিরুদ্ধে পুলিশের লড়াই চলছেই। সাধারণ মানুষকে সচেতনতার পাঠ দেওয়া। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। মাস্ক বিতরণ। নিরন্ন মানুষের হাতে খাবার পৌঁছে দেওয়া। একাকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রতি বিশেষ নজর রাখা থেকে শুরু করে অবুঝ শহরবাসীকে রাস্তাঘাটে থুতু ফেলা থেকে বিরত রাখা। তার উপরে রয়েছে কোরোনা আক্রান্তকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। কনটেইনমেন্ট জ়োনগুলিতে নজরদারি কিংবা কোরোনায় মৃতের সৎকারের ব্যবস্থা। সব দিকেই নজর রাখতে হচ্ছে কলকাতা তথা রাজ্য পুলিশকে। সবথেকে বেশি দায়িত্ব নিতে হচ্ছে শহুরে পুলিশকে অর্থাৎ রাজ্যের কমিশনারেটগুলিকে। কারণ কোরোনার সংক্রমণ সবথেকে বেশি শহরেই। সেই সূত্র ধরে বহু পুলিশকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন। অথচ লকডাউন পর্ব থেকেই কলকাতা তথা রাজ্য পুলিশের জন্য অভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর (SOP) চালু করেছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর। সেভাবেই চলছে কাজ।
পুলিশকর্মীদের কোরোনা ঠেকাতে SOP, পুলিশের এখন নীলকণ্ঠেক দশা। প্রতি পদে বিপদ বাসা বেঁধে আছে। কর্তারা করেছেন সুরক্ষা পরিকল্পনা। গোটা বাহিনী কর্তব্যে অবিচল। সেই সূত্র ধরেই কলকাতা পুলিশে বাড়ছে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যা। তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক। তবু তিলোত্তমাকে বাঁচাতে বিষপানে রাজি পুলিশ। লকডাউনের শুরু থেকেই শহরবাসীর একাংশকে খাবার জুগিয়ে চলেছে কলকাতা পুলিশ। ফুটপাতবাসীদের জন্য বিভিন্ন নাইট সেল্টার থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন বস্তি এলাকা। কর্তব্যে অবিচল থেকে সকাল বিকাল খাবার জুগিয়ে গেছে কলকাতার 79 টি থানা। সঙ্গী ছিল ট্র্যাফিক পুলিশ। সেই নিয়মে ভাটা পড়েনি আমফানের মতো ব্যতিক্রমী দিনেও। এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কলকাতা পুলিশ নিরন্নের মুখে তুলে দেয় অন্ন। হয়তো এই কারণেই শহরবাসীর একাংশের কাছে কলকাতা পুলিশ এখন "অন্নপূর্ণা"। অথচ আমফানের জেরে শহর কলকাতা রীতিমতো দাঁড়িয়ে ছিল ভগ্নস্তূপে। লণ্ডভণ্ড শহরকে ছন্দে ফেরাতে দিনরাত এক করে কাজ করেছে পুলিশ। দমকল, পৌরনিগমের কর্মী, ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের পাশাপাশি হাত লাগিয়েছে সাধারণ পুলিশকর্মীরাও। সাদা উর্দি পরে করাত চালানোর এমন দৃশ্য এর আগে দেখেনি তিলোত্তমা। এমন রাস্তা নেই, যেটি কোনও না কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কোথাও ভেঙে পড়েছিল গাছ। কোথাও ইলেকট্রিক পোস্ট। কোথাও ছিঁড়েছে ইলেকট্রিকের তার। বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ড ভাঙা। কোরোনা লড়াইয়ের মাঝে আমফান এনেছিল পুলিশের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার পরেই পুলিশের সংক্রমণ যেন বেড়ে যায় অনেকটাই। তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে কলকাতা পুলিশে 270 জনের বেশি আক্রান্ত। গোটা রাজ্যে সংখ্যাটা 300 ছাড়িয়েছে।অথচ লকডাউন শুরুর পর এই পুলিশের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কায় তৈরি করা হয়েছিল SOP। প্রত্যেকটি কমিশনারেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী ডিউটি ঠিক করতে। বলা হয়েছে, বয়স অনুযায়ী ঠিক করতে হবে ডিউটি রোস্টার। তথ্য বলছে, বেশি বয়সের মানুষজনের সংক্রমণ প্রবণতা বেশি। কারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। মৃত্যুর দিক থেকেও গোটা পৃথিবীতেই বয়স্কদের পাল্লা ভারী। সেই কারণে বলা হয়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ ডিউটিতে বয়স্কদের না রাখার জন্য। পাশাপাশি সমস্ত পুলিশকর্মীদের মধ্যে কাদের কী ধরনের অসুখ আছে তার তালিকা তৈরি করতে বলা হয়। যাঁরা জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের ঝুঁকিপূর্ণ ডিউটি থেকে বিরত রাখার জন্য বলা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কমিশনার মনোজ ভর্মা বলেন, “ আমরা খাদ্যতালিকা থেকে শুরু করে সবকিছুর আলাদা আলাদা করে SOP তৈরি করেছি। যারা কনটেইনমেন্ট জ়োন কিংবা কোরোনা রোগীদের সরাসরি সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের জন্য পৃথক খাদ্য তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর রেখেই সেই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সাধারণভাবে যারা সুগার, প্রেসার, COPD জাতীয় অসুখে ভুগছেন তাঁদের কোনও ঝুঁকিপূর্ণ ডিউটি দেওয়া হয়নি। পুলিশকর্মীদের জন্য দেওয়া হচ্ছে বেশ কিছু ওষুধ । প্রতিটি থানায় অন্তত 50 টি করে PPE সবসময় স্টকে রাখা হচ্ছে। থানাগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থা। পর্যাপ্ত পরিমাণে হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার গ্লাভস, মাস্ক দেওয়া হয়েছে পুলিশকর্মীদের।" লালবাজারের তরফে যুগ্ম-কমিশনার সদর শুভঙ্কর সিনহা সরকার বলেন, “ পুলিশকর্মীদের সুরক্ষা আমাদের কাছে অগ্রাধিকার। আমরা সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করেছি। SOP অনুযায়ী ডিউটি রোস্টার তৈরি করা হচ্ছে। যাঁরা সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের মাস্কের পাশাপাশি ফেসিয়াল ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে।" কলকাতা পুলিশের অন্তত চারজন OC , বেশ কয়েকজন সাব-ইন্সপেক্টর, অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর, কনস্টেবল, সিভিক ভলান্টিয়ার কোরোনায় আক্রান্ত। শুধু তাই নয়, পুলিশ পরিবারের অনেকেও সংক্রমণের শিকার। তাঁদের অনেকে ইতিমধ্যেই অবশ্য সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু রোজই নতুন নতুন সংক্রমণের খবর আসছে। সেই সংক্রমণ যাতে কোনোভাবেই আরও ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেই কারণে সতর্কতামূলক বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে লালবাজার। এর আগে লালবাজারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, গাড়ির নথি দেখার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির থার্মাল স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি নাকা চেকিংয়ে থাকা পুলিশকর্মীদের জন্য ফেস সিলড মাস্ক, গ্লাভস পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত সব পুলিশকর্মী ফেস সিলড ব্যবহার করছেন না। সে ক্ষেত্রে গাড়ির কাগজ জমা করতে বলা হচ্ছে একটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে। দূরত্ব বজায় রেখে সেই প্যাকেট থেকে নথি দেখে আবার সেখানেই রাখছেন পুলিশকর্মীরা। লালবাজারের বলা হয়েছিল, থানায় ডিউটি করা কর্মীদের বারবার হাত ধোয়ার জন্য। থানায় আসা ব্যক্তিরা যাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার ব্যবহারের পর থানায় ঢুকতে পারেন তা নিশ্চিত করতে বলা হয়। থানাগুলিকে প্রতিদিন জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে লালবাজারে তরফে। একইসঙ্গে নগরপাল সব DC-কে নির্দেশ দিয়েছেন, কোন ডিভিসনে কত পুলিশকর্মী এই মুহূর্তে জ্বর এবং অন্যান্য উপসর্গের ভুগছেন তার তালিকা পাঠাতে। অবিলম্বে তাঁদের হোম কোয়ারানটিন করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, পুলিশকর্মীকে ডিউটি করার সময় মাস্ক এবং গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে। থানাগুলির পাশাপাশি পুলিশ আবাসনগুলিকেও নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কনটেইনমেন্ট জ়োনসহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা পুলিশকর্মীদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সামান্য অসুস্থতা দেখা দিলেই পুলিশকর্মীদের পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে লালবাজার। ইতিমধ্যেই শুধুমাত্র কলকাতায় হাজারের বেশি পুলিশকর্মীর সোয়াবের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে।পুলিশকর্মীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যেই নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। বিশেষ আয়ুর্বেদিক পাচনের জন্য দেওয়া হয়েছে অর্ডার। এমনকী যারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছেন তাঁদের হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া হয়েছে। কলকাতা পুলিশের DC ট্র্যাফিক রূপেশ কুমার নিজে মাঝেমধ্যেই পথে বের হচ্ছেন। বৃষ্টিতে কাজ করা ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীদের দিয়ে আসছেন গরম হরলিক্স। কারণ চিকিৎসকরা বারবার বলছেন দিনে বেশ কয়েকবার গরম তরল খাওয়া দরকার। এত সব কিছুর পরেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। কলকাতা পুলিশের তিনটি বিক্ষোভের ঘটনাতেই উঁচুতলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন নিচুতলার কর্মীরা। পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে বিক্ষোভের ঘটনায় ক্ষোভ ছিল DC কমব্যাটের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠে, যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই কনটেইনমেন্ট জ়োনে ডিউটিতে পাঠানো হচ্ছে বাহিনীর জওয়ানদের। দেওয়া হচ্ছে না পর্যাপ্ত স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক। 19 মে কলকাতা পুলিশের কমব্যাট ফোর্সের একজন কোরোনায় আক্রান্ত হন। কোয়ারানটিন করা হয় 19 জনকে। বিক্ষোভকারী পুলিশকর্মীদের দাবি ছিল, তাঁদের কোয়ারানটিন করা হয়েছে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলেই(PTS)। আর এখান থেকেই দানা বাঁধতে শুরু করে অসন্তোষ। সঙ্গে যোগ হয় আরও বেশ কয়েকটি বিষয়। অভিযোগ, কোরোনা মোকাবিলায় কাজ করা পুলিশকর্মীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার পাচ্ছেন না। অনবরত কাজ করে চলা পুলিশকর্মীরা একদিনের জন্যও ছুটি পাননি লকডাউনের মাঝে। এ নিয়ে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। যার বিস্ফোরণ হয় সেই রাতে। রীতিমতো লাঠি, বাঁশ হাতে পথে নেমে পড়েন তাঁরা। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ DC-র কাছে অভিযোগ জানাতে যান একদল পুলিশকর্মী। তারপরই শুরু হয় পুলিশ বিক্ষোভ। প্রায় 500 পুলিশকর্মী এরপর রাস্তায় নেমে পড়েন। অবরুদ্ধ হয়ে যায় রাস্তা। বিক্ষোভকারী পুলিশকর্মীরা শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত করেন DC কমব্যাটকে। এমনকী পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের অন্দরমহলে নাকি চালানো হয় ভাঙচুর। পরের দিনই নবান্ন যাওয়ার পথে সেখানে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোনেন অভাব-অভিযোগ। আশ্বাস দেন ব্যবস্থা নেওয়ার। এই ঘটনার পর সটলেক এবং গড়ফা থানায় বিক্ষোভ হয়। সল্টলেকের বিক্ষোভের জেরে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এক অ্যসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর সহ চার কনস্টেবলের বিরুদ্ধে। সরিয়ে দেওয়া হয় একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে । তারপর পুলিশ ডাইরেক্টর থেকে কলকাতা পুলিশের 13 জন কর্মীর বদলির নির্দেশিকা জারি হয়। তার মধ্যে 6 জন কমব্যাট ব্যাটেলিয়নের সদস্য। একজন কমব্যাট ব্যাটেলিয়নের সদস্য হয়েও ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে কর্মরত ছিলেন। পাঁচজন প্রথম এবং দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নের সদস্য। তাঁরা ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে কাজ করতেন। আর একজন র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সে কর্মরত ছিলেন। এদের বদলি করা হয়েছে মূলত কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং জেলায়। পাশাপাশি বদলি করা হয়েছে ডেপুটি কমিশনারকেও। সেই সূত্র ধরেই লালবাজারে সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের কাছে সৈনিক সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন খোদ পুলিশ কমিশনার। লালবাজার সূত্রের খবর এমনই। প্রতি মাসে দুবার করে এই সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই সম্মেলনে নিচুতলার কর্মীদের বক্তব্য শুনতে হবে। তার রিপোর্ট পাঠাতে হবে লালবাজারে।