মায়ের সোনা, জমি বন্ধক রেখে বাবার চিকিৎসা, পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পেল না ছেলে
কোরোনা আক্রান্ত সন্দেহে এক ব্যক্তিকে ভরতি করানো হয় তিলজলা রোডে অবস্থিত বেসরকারি একটি নার্সিংহোমে ৷ চিকিৎসার মধ্যেই ওই ব্য়ক্তির ছেলে তাঁকে অন্য হাসপাতালে ভরতির জন্য নিয়ে যেতে চান ৷ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তখন বকেয়া টাকা মেটানোর কথা বলে ৷ টাকা হাতে পেয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় তাঁর বাবা মারা গিয়েছেন ৷
কলকাতা, 7 সেপ্টেম্বর: মায়ের সোনা, নিজেদের জমি বন্ধক রেখে বাবার চিকিৎসার খরচ যোগাড় করেছেন ছেলে। অথচ, তাঁর বাবাকে কলকাতায় নিয়ে আসার পরেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এ দিকে, তাঁর বাবা COVID-19-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না, এই বিষয়েও ছেলের সন্দেহ রয়েছে। নার্সিংহোম যেদিন বলেছিল, তারও দুই দিন আগে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। এ সব কারণে, পোস্টমর্টেম করানো হয়েছে। কিন্তু, পোস্টমর্টেমের চার দিন পরেও রিপোর্ট জানতে পারলেন না ছেলে। শুধুমাত্র তাই নয়। এখনও তাঁর বাবার শেষকৃত্যও সম্পন্ন হয়নি। তাই, এখনও চলছে অপেক্ষা। আর, ছেলের কথায়, এমন ঘটনা যেন অন্য আর কারও সঙ্গে না হয়।
বছর ৫৫ বয়সি মৃত এই রোগী হুগলির চন্ডীতলা থানা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। গত 1 সেপ্টেম্বর কলকাতার কড়েয়া থানায় মৃত এই রোগীর ছেলের দায়ের করা অভিযোগপত্রে এমনই জানানো হয়েছে, তিলজলা রোডে অবস্থিত বেসরকারি একটি নার্সিংহোমে গত 25 অগাস্ট দুপুরে তাঁর বাবাকে ভরতি করানো হয়েছিল। ওই দিন বিকালে তাঁর বাবার COVID-19 টেস্ট করানো হয়। পরের দিন বিকালে টেস্টের রিপোর্টে জানানো হয় তাঁর বাবা COVID-19 পজিটিভ। গত 26 অগাস্টের পর থেকে গত 30 অগাস্ট বিকাল পর্যন্ত তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। বেসরকারি ওই নার্সিংহোম থেকে গত 31 অগাস্ট তাঁকে বিলের বাকি টাকা জমা দিতে বলা হয়। তিনি ওই নার্সিংহোমকে জানান তাঁর বাবাকে তিনি অন্য নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে চান।
মৃত এই রোগীর ছেলে বলেন, "বাবাকে আমরা অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করছিলাম। এর জন্য অ্যাম্বুলেন্সেও ফোন করেছিলাম। গত 31 অগাস্ট বাবাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা তিলজলা রোডের ওই নার্সিংহোমে আমরা বলি। ওই নার্সিংহোম থেকে তখন বিলের বাকি 47 হাজার টাকা জমা দিতে বলা হয়। এই টাকা জমা দেওয়ার পরে বাবাকে দেখতে চাই। কিন্তু, বাবাকে দেখতে দেওয়া হয় না। ওই নার্সিংহোম থেকে তখন বলা হয়, আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে।" তিনি বলেন, "বাবাকে দেখার জন্য আমরা জোর করি। এর পরে আমার বাবাকে দেখানো হয়। বাবার চোখ দেখি কালো হয়ে গিয়েছে। দুই-তিন দিন আগে মৃত্যু না হলে চোখ এরকম কী করে হয় ?"
কলকাতার তিলজলা রোডের বেসরকারি ওই নার্সিংহোমে তাঁর বাবার চিকিৎসার জন্য তিনি মোট 2 লাখ 61 হাজার টাকা দিয়েছেন। এ কথার পাশাপাশি পুলিশে দায়ের করা ওই অভিযোগপত্রে মৃত এই রোগীর ছেলে এমনই জানিয়েছেন, তাঁর বাবা COVID-19-এ আক্রান্ত হননি। বেসরকারি যে ল্যাবরেটরি থেকে তাঁর বাবার COVID-19 টেস্টের রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল, সেই ল্যাবরেটরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ওই অভিযোগপত্রে তিনি জানিয়েছেন। মৃত এই রোগীর ছেলে ওই অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার মৃত্যু দুই দিন আগে হয়েছে অথচ, এ কথা ওই নার্সিংহোম থেকে তাঁকে বলা হয়নি। এই জন্য ওই নার্সিংহোমের বিরুদ্ধেও ব্য়বস্থা নেওয়ার কথাও ওই অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন তিনি।
বেসরকারি ওই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের তরফে এই ধরনের অভিযোগ ওই দিন অস্বীকার করা হয়েছিল। তবে, COVID-19-এ আক্রান্ত ছিলেন বলে সরকারি প্রোটোকল অনুযায়ী পরিজনদের হাতে এই রোগীর মৃতদেহ তুলে দিতে চায়নি বেসরকারি ওই নার্সিংহোম। তাই, এই মৃতদেহের সৎকারের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই নার্সিংহোম। এ দিকে, সরকারি প্রোটোকল অনুযায়ী, এক্ষেত্রে মৃতদেহ প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মৃত রোগীর পরিজনদের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু, এই সম্মতি দিতে চায়নি পরিজনরা। তাঁরা দাবি করতে থাকেন, তাঁদের রোগী COVID-19-এ আক্রান্ত ছিলেন না। বেসরকারি ওই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের তরফে গোটা বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। শেষ পর্যন্ত পুলিশের হস্তক্ষেপে এই মৃত রোগীর পোস্টমর্টেমের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মৃত এই রোগীর দেহ পোস্টমর্টেমের জন্য গত 1 সেপ্টেম্বর পাঠানো হয় NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। পরের দিন সেখানে মৃত এই রোগীর দেহের পোস্টমর্টেম করা হয়। রবিবার, 6 সেপ্টেম্বর মৃত এই রোগীর ছেলে বলেন, "গত 2 সেপ্টেম্বর NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে আমাদের বলা হয়, দুই-তিন পরে থানার মাধ্যমে বাবার পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট জানতে পারব। এখনও পর্যন্ত বাবার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানতে পারলাম না। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে না বলেও আমাদের জানানো হয়েছে। আমরা এখনও অপেক্ষা করছি।"
মৃত এই রোগীর ছেলে বলেন, "কলকাতায় বাবার চিকিৎসার জন্য মায়ের সোনা, আমাদের জমি বন্ধক রেখে টাকার যোগাড় করেছি। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার জন্য বাবার মৃত্যু হল। এই জন্য বাবার মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করাতে চেয়েছি।" তিনি বলেন, "বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না। আমার সঙ্গে যা হয়েছে, এ রকম যেন আর কারও সঙ্গে না হয়।"