পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / city

অভাবের সংসারে সবিতা একাই তিন ছেলেমেয়ের বাবা-মা

বিয়ের সাত বছরে প্রয়াত হন স্বামী। তারপর থেকে বাজারে সবজি বেচে, ফুল বেচে তিন ছেলেমেয়েকে বড় করার লড়াই মায়ের। আজ তাঁরা শিক্ষিত। আমার জীবনে এটাই সাফল্য, বলছেন সবিতা বসাক।

Sabita is the only parent of three children
কলকাতা

By

Published : May 11, 2020, 12:59 AM IST

রানাঘাট, 10 মে: চার জনের সংসার। তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে নিয়মিত লড়াই করে চলেছেন একাকী মা। অন্য লড়াইয়ের গল্প। গল্প নয়, সত্যি। বিয়ের পর মাত্র সাত বছরের সংসার স্বামীর সঙ্গে। তারপর থেকেই একলা জীবন, একার লড়াই। তিন ছেলেমেয়ে যখন ছোট সেই সময় অকালে প্রয়াত হন স্বামী কার্তিক বসাক। যমজ দুই মেয়ের পর এক ছেলে। পিঠোপিঠি যমজ দুই দিদির এক ভাই। স্বামী যখন বেঁচে সেই কয়েকদিনের "সোনার সংসারে"-এর কথা বলতে বলতে চোখে জল চলে আসে বছর পঞ্চান্নর সবিতা বসাকের। তবু তাঁর সাফল্য, সন্তানদের শিক্ষিত করতে পেরেছেন তিনি।

স্থানীয় জুট মিলে কাজ করতেন কার্তিক বসাক। হৃদরোগে স্বামীর অকাল মৃত্যু হয়। সন্তানদের জন্য সংসারের ভার মাথা পেতে নিয়েছিলেন সবিতা বসাক। তিন সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। গড় বাঁচার থেকে কঠিন লড়াই। স্থানীয়বাজারে ফুল বিক্রি করেন সবিতা বসাক। ফুল বিক্রির পয়সা থেকেই সংসার চালানোর পাশাপাশি তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালান। দেখতে দেখতে সদ্য কলেজ পাশ করেছে জমজ দুই মেয়ে। ছেলে এখনও স্কুলে পড়ে। সামনের বছর উচ্চমাধ্যমিক দেবে। সবিতার কথায়, এই যে তিন ছেলেমেয়ে পড়াশুনো করে বড় হল, এইটাই তাঁর সাফল্য। কিন্তু, তার জন্য বহু পরীক্ষা দিতে হয়েছে সবিতা বসাককে।

স্বামী মারা যাওয়ার পর বাজারে সবজি, মুরগির ডিম বিক্রি করতে শুরু করেন। এখন কেবলই ফুল বিক্রি করেন। হাতে সময় থাকলে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুড়ি দিয়ে আসেন। সবিতা জানান, এমনও দিন গেছে, তিন সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পর হাঁড়ির কোনায় এক মুঠো ভাত ছিল না। কলেজ পাস মেয়েরা এখন বাড়িতে টিউশন করে। সেই টাকা মেয়েদের বিয়ের জন্যেই সঞ্চয় করছেন মা।

সবিতা বসাক জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর বাপের বাড়ি থেকে মাসকয়েক চাল এনে দু'বেলা সেদ্ধ ভাত খেয়েছি। লকডাউনে এখন বাজারে বিক্রি নেই। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দুর্দিনের কথা। কোরোনার প্রকোপে আজ সারা দিনে মাত্র ৬০ টাকার বেচাকেনা হয়েছে। এদিকে সংসারের চাল ফুরিয়ে এসেছে। সরকার থেকে রেশনে চাল দেওয়ার কথা ছিল। এখনও তা জোটেনি সবিতা বসাকের। তবু, মুখ বুজে, অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মা।

সবিতা বসাক বলেন, "যখন ওদের বাবা মারা যায়, সেই সময় মাত্র 8 টাকা ছিল ঘরে। আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর সাহায্যে দিন দশেক বাজার করতে হয়নি। এক মাস ঘুরতে না ঘুরতেই বাজারে সবজি নিয়ে বসলাম। প্রথম প্রথম পেরে উঠতাম না। হিসেবে ভুল করতাম। অনেকেই ঠকিয়ে যেতেন।"

দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়েন সবিতা বসাক। তারপর বলেন, "দুই মেয়েকে ঘরে রেখে, ছেলেকে নিয়েই বাজারে বসতাম। সংসারের স্বচ্ছলতা না থাকলেও, সেই থেকে দু'বেলা দুটো খাবার জুটে যাচ্ছে তো। ওদের বাবাও তো খুব অল্প মাইনে পেতেন। তবু, কম পয়সায় আনন্দেই ছিলাম। আর ওদের বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে বুক দিয়ে আগলাচ্ছি সংসারটাকে।"

আশায় বুক বাঁধেন মা। লকডাউন উঠে গেলে আবার ভালো বেচাকেনা হবে। সংসার চালাতে কষ্ট হবে না লড়াকু মায়ের। চার জনের সংসারে এখনও প্রধান চালিকাশক্তি তো মা সবিতা বসাকই। দু'কামরার ঘরের বিদ্যুতের বিল থেকে সবই মেটান তিনি। কিন্তু, আতঙ্কে আছেন, কোরোনায় কিছু হবে না তো তাঁর ছেলেমেয়েদের। তাঁর হলেই যে...। তাঁকে যে মাঝেমাঝে বাজারে বসতেই হয় ফুল নিয়ে। তবু, লকডাউনে নিয়মিত বাজারে গিয়ে উঠতে পারেন না‌ তিনি। পুঁজি ভাঙিয়েই সংসার চলছে এখন।

লড়াকু মা সবিতা বসাক বলেন, "তবু, লড়াই ছাড়লে তো চলবে না। ওদের বাবা চলে যাওয়ার পর আমিই যে ওদের বাপ-মা দুই।"

ABOUT THE AUTHOR

...view details