কলকাতা, 23 জানুয়ারি : অঙ্গদানে নতুন জীবন-এই মন্ত্রেই এখন বিশ্বাসী কলকাতার মানুষ ৷ আগে অঙ্গদানের জন্য রাজি হত না কেউ ৷ এখন আর নতুন করে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার প্রচার করতে হয় না, এখন তারা নিজেই সচেতন ৷ কলকাতায় ফের ব্রেন ডেথ ঘোষিত এক রোগীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হল অন্য রোগীদের শরীরে । গত নয় দিনের মধ্যে শহরে এটি তিন নম্বর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনা ৷ গতকাল ব্রেন ডেথ ঘোষিত কল্যাণকুমার রায়চৌধুরির লিভার এবং দুই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হল অপর দুই রোগীর শরীরে ।
গত সোমবার, ২০ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ হাওড়ার বালির বাসিন্দা কল্যাণকুমার রায়চৌধুরি (৬৭) সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন । সিমলাগড়ে জি টি রোড পার করে এই প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী যখন আসছিলেন, তখন একটি গাড়ি তাঁকে ধাক্কা মারে ৷ তিনি টাল সামলাতে না পেরে সাইকেল থেকে পড়ে যান । তাঁর মাথায় আঘাত লাগে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয় । মারাত্মকভাবে জখম কল্যাণকুমার রায়চৌধুরিকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় পান্ডুয়া গ্রামীণ হাসপাতালে । সেখানে তাঁর মাথায় সেলাই করা হয় । এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরপাড়ার একটি হাসপাতালে । সেখান থেকে আবার উত্তর পাড়ারই অন্য একটি হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় । তবে চিকিৎসার জন্য সুপার স্পেশালিটি কোনও হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে সেই হাসপাতাল থেকে রোগীকে রেফার করে দেওয়া হয় । এর পরে উলটোডাঙার কাছে EM বাইপাসের ধারে অবস্থিত একটি বেসরকারি হাসপাতালে গত ২০ জানুয়ারির সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে আসা হয় । সেখানে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয় । তবে, শেষ পর্যন্ত কল্যাণকুমার রায়চৌধুরিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি । গত মঙ্গলবার রাতে তাঁর ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয় হাসপাতালের তরফ থেকে ।
শহরে ফের অঙ্গদান, প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে হার্ট-লিভার-কিডনি
এরপরই কল্যাণকুমার রায়চৌধুরির স্ত্রী এবং দুই মেয়ে তাঁর অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নেন । কল্যাণকুমার রায়চৌধুরির বড় মেয়ে ইপ্সিতা রায়চৌধুরি ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুলের শিক্ষিকা । তাঁর বোন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে সাম্মানিক ইংরেজির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। ইপ্সিতা বলেন, ‘অন্য মানুষের উপকার হবে, সেই জন্যই আমরা বাবার অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি ৷ আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গিয়েছে। কিন্তু অঙ্গদান করলে অন্য মানুষের উপকার হবে। এটাও তো সোশাল সার্ভিস।" যে যে অঙ্গ প্রয়োজন হবে, সেই অঙ্গগুলি দান করার কথা তাঁরা জানিয়েছিলেন ।
শেষ পর্যন্ত, কল্যাণকুমার রায়চৌধুরির লিভার SSKM হাসপাতালে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে সাহানা খাতুন (৩০) নামক এক রোগীর শরীরে । তাঁর দুই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে মুকুন্দপুরে অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সী এক মহিলা রোগীর শরীরে । ব্রেন ডেথ ঘোষিত কোনও রোগীর দুটি কিডনিই একই রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনের ঘটনা পূর্ব ভারতে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ঘটল । ঘটনাচক্রে, প্রথমবারও এই ঘটনা হয়েছিল মুকুন্দপুরের এই বেসরকারি হাসপাতালে । বয়সজনিত কারণে কল্যাণকুমার রায়চৌধুরির হার্ট অন্য কোনও রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি।
এর আগে গত ১২ জানুয়ারি রাতে পথ দুর্ঘটনায় জখম পূর্ব মেদিনীপুরের মারিশদা থানার ভাজাচাউলি গ্রামের বাসিন্দা স্বপন হাজরা (৪৫)-র ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়েছিল SSKM হাসপাতালে । ১৩ জানুয়ারি তাঁর দুই কিডনি এবং হার্ট SSKM হাসপাতালেরই তিন রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল । তাঁর লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল মুকুন্দপুরে অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালে অন্য এক রোগীর শরীরে । এরপরে SSKM হাসপাতালে গত ১৯ জানুয়ারি পথ দুর্ঘটনায় জখম সুজয় কর্মকারের (২০) ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হলে পরের দিন, ২০ জানুয়ারি ব্রেন সুজয়ের দুই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল SSKM হাসপাতালের দুই রোগীর শরীরে । তাঁর হার্ট প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এক রোগীর শরীরে । তাঁর লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল উল্টোডাঙ্গার কাছে EM বাইপাসের ধারে অবস্থিত বেসরকারি এক হাসপাতালে । শহরে একের পর এক অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনায় নতুন করে বাঁচার আশা দেখছে অপেক্ষায় থাকা বহু রোগী৷