কলকাতা, 13 সেপ্টেম্বর : কোরোনার প্রকোপে আজ জর্জরিত গোটা বিশ্ব । চরম ধাক্কা খেয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি । বাদ নেই ভারতও । ধুঁকছে শিল্প ও বাণিজ্য । গতবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় এবছর ভারতের গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (GDP) 23.9 শতাংশ কমেছে । অর্থনীতির নিরিখে, বিগত প্রায় চার দশকে GDP বৃদ্ধির হারে এটাই সবথেকে বড় ধাক্কা দেশে । কর্মীছাঁটাই থেকে শুরু করে বেতনে কাঁট-ছাট… কোপ পড়েছে অসংখ্য মানুষের কপালে । আর এর সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়েছে পর্যটন শিল্পের উপরে । কোরোনার প্রাদুর্ভাবে বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিল্প – পর্যটন । আন্তর্জাতিকস্তরের এক সমীক্ষায় আশঙ্কা করা হয়েছে, COVID 19-এর ধাক্কায় পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় চার কোটিরও বেশি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন । পাশাপাশি বহু ছোটো পর্যটন সংস্থা পেশা পরিবর্তন করতে পারে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে সমীক্ষায় ।
সংক্রমণ এড়াতে চিকিৎসকরা বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বারবার। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না । অন্যদিকে এখনও স্বাভাবিক নয় ট্রেন । স্পেশাল ট্রেনগুলি ছাড়া বাকি সমস্ত নিয়মিত ট্রেন বাতিল রাখা হয়েছে । অন্তর্দেশীয় বিমান পরিষেবা স্বাভাবিক হলেও আন্তর্জাতিক উড়ান এখনও নিয়মিত হয়নি । এয়ার বাবল চুক্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু দেশের সঙ্গেই চালু রয়েছে আন্তর্জাতিক উড়ান পরিষেবা ।
এই পরিস্থিতিতে বিশাল অঙ্কের ধাক্কার মুখে পর্যটন শিল্প । একেবারে কোমর ভেঙে যাওয়ার দশা । পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যবসায়ীই মনে করেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সবার মনে যে ভয় বাসা বেঁধেছে সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে এবং ভ্রমণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে । অনেকের মনেই ঘুরতে গিয়েও বাড়ির মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে একটা খুঁতখুঁতে ভাব থাকবে । এটি একটি মনোস্তাত্বিক ব্যাপার । পাশাপাশি হোটেলের ঘরগুলি ঠিক মতো স্যানিটাইজ় করা হচ্ছে কি না, সেটিও একটি বড় চিন্তার বিষয় ।
আর এই সবের পাশাপাশি সবথেকে বড় যে সমস্যা তা হল আর্থিক দিকটি । যে হারে চাকুরিজীবীদের বেতনে কাঁট-ছাট করা হয়েছে এবং কর্মীছাঁটাই হয়েছে, সেই দিকটি বিবেচনা করলে দেখা যাবে, মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া শহর ছাড়তে চাইছেন না । তাই দেশের মধ্যে বা বিদেশে অতন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকা সত্বেও টিকিট বুক করে পরে আবার তা বাতিল করছেন, এমন মানুষও রয়েছেন বিস্তর।
কাজ হারানোর আশঙ্কায় 4 কোটিরও বেশি মানুষ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বহু ব্যবসা । প্রতি 10 টি চাকরির মধ্যে একটি চাকরি পর্যটন ক্ষেত্রে । ভারতের GDP-র প্রায় 9 শতাংশ আসে পর্যটন ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ক্ষেত্রগুলি থেকে। পাশাপাশি ফরেন এক্সচেঞ্জ থেকে আয়ের দিক থেকে পর্যটন রয়েছে তৃতীয় স্থানে।
আরও পড়ুন :গত বছরের তুলনায় 23.9 শতাংশ পড়ল দেশের GDP
সামনেই দুর্গাপুজো । ভ্রমণপিপাসু বাঙালির একটা বড় অংশ এই ছুটিটাকে পুরোদস্তুর কাজে লাগান । ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন । কেউ পাহাড়ের টানে… কেউ সাগরকে ভালোবেসে… কেউ আবার অন্য কোনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে । কিন্তু এবার ঘুরতে যাওয়াটা একেবারেই সিলেবাসে নেই এই ভ্রমণপিপাসু বাঙালিদের মধ্যে । বিদেশ তো দূরে থাক, দেশের মধ্যেও অন্য কোথাও পা ফেলতে চাইছেন না মানুষ । কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা অনুসারে খুব প্রয়োজন না হলে অর্থাৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা আপৎকালীন কোনও পরিস্থিতি না হলে নিজের শহর ছেড়ে অন্যত্র না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে । শুধু দুর্গাপুজোর মরশুমই না… বড়দিনের ছুটিতেও ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় এতদিনে । কিন্তু এবার বড়দিনের ছুটিতেও ঘুরতে যাওয়ার কোনও তোড়জোর নেই মানুষের মধ্যে ।
একটি পর্যটন সংস্থার COO কৌশিক ঘোষ বলেন, "পর্যটন শিল্প একটি বিশাল ধাক্কা খেয়েছে । ব্যাপক লোকসান হয়েছে । ফেব্রুয়ারি মাসে গোড়া থেকেই ব্যবসায় ব্যাপক মন্দা চলছে । তাই এই পরিস্থিতিতে টুরিজ়ম শিল্পে আগামী চার থেকে পাঁচ মাস ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে পেশায় টিকে থাকাটা বেশ কঠিন হবে । একটি সমীক্ষা বলছে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে 20 লাখ টাকার আর্থিক প্যাকেজের ঘোষণা করা হলেও পর্যটন শিল্পে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার কোনও লাভ হয়নি।"তিনি আরও বলেন, "আগামী দুই থেকে তিন বছর বাণিজ্যিক পর্যটন (কর্পোরেট ট্রাভেল) একেবারেই হবে না বলে আমার বিশ্বাস । কারণ সব ক্ষেত্রেই যে ব্যাপক পরিমানে লোকসান হচ্ছে তার ফলে সংস্থাগুলি এই ধরণের বানিজ্যিক পর্যটন তেমনভাবে করবে না বললেই চলে । তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গৃহবন্দী মানুষ সবাই আবার ভ্রমণমুখী হবে। লকডাউন ও কোরোনার পর মানসিকতার পরিবর্তন হবে । তাই এবার কিছুটা শান্তি ও মুক্ত বাতাসের খোঁজে আবার সবাই বেরিয়ে পড়বেন কাছে-পিঠে ।" আরও পড়ুন :কোটি কোটি চাকরি হারা হয়েছেন , GDP-র পতন ঐতিহাসিক : রাহুল
সমস্ত ছোটবড় ভারতীয় পর্যটক সংস্থার এখন কপালে হাত পড়েছে । বিশেষ করে দেশের যে রাজ্যগুলি পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল সেসব জায়গায় আবার কবে থেকে পর্যটক সমাগম শুরু হবে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন । পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সংক্রমণ যাতে আবার বিকট আকার না নেয় তাই নানান বিধি ও নিষেধাজ্ঞা যে থাকবে তা বলাই বাহুল্য।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্যুর অপারেটরসর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি ও বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স ট্যুরিজ়ম কমিটির চেয়ারম্যান দেবজিত দত্ত বলেন যে, "ব্যবসা নেই বলে পর্যটন ও পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ক্ষেত্র মিলিয়ে প্রায় চার কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন । ইতিমধ্যেই সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে । 2019 সাল অবধি ভারতে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল 10.2 মিলিয়ানের কাছাকাছি । এখন তা একেবারেই নেই । ঠিক সেভাবেই আন্তঃরাজ্য পর্যটনও একেবারেই বন্ধ হয়ে রয়েছে ।"
কেন্দ্র সরকারের তরফে এই পরিস্থিতিতে পর্যটন শিল্পের হাল ফেরাতে তেমন কোনও সহায়তা মেলেনি বলেও জানিয়েছেন তিনি । দেবজিতবাবুর কথায়, "আগামী দিনে কোরোনার পাকাপাকিভাবে কোনও ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক না আসা পর্যন্ত এই ব্যবসার পুনরুদ্ধার করতে পারাটা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। এই ব্যবসাকে ঘুরে দাঁড়াতে অন্তত আগামী দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে।"
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশে অক্টোবর মাসে থেকে শুরু করে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভ্রমণ ব্যবসার ভরা মরশুম। পুজোর ছুটি, বড়দিনের ছুটি এছাড়াও দেশ-বিদেশে মধুচন্দ্রিমার বিশেষ প্যাকেজ তো রয়েছেই । কিন্তু কোরোনার দাপটে এখন ভাটা পড়েছে ভ্রমণে ।
আরও পড়ুন :ঋণ নিয়ে গরিবের হাতে নগদ দিন, কেন্দ্রকে পরামর্শ চিদম্বরমের
অন্য এক পর্যটন সংস্থার কর্ণধার চন্দন মুখোপাধ্যায় বলেন , “আপাতত পর্যটন শিল্পের অবস্থা একটি ডুবন্ত জাহাজের মত । আশা বন্ধ হয়ে গেছে । কোনওরকম আয়-উপার্জন নেই । ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকার । যেহেতু গ্রীষ্মের ছুটি সব থেকে লম্বা ছুটি হয় তাই এই সময় আমাদের সব থেকে বেশি ব্যবসা হয় । তবে এবারে কোনও ব্যবসাই হয়নি । এপ্রিল মাসের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পর্যটন ও পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ব্যবসায় ক্ষতি হতে চলেছে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা । কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের তরফে এই শিল্পকে আবার চাঙ্গা করার জন্য কোনওরকম ঘোষণা করা হয়নি ।"
আনলক 4 চালু হয়েছে । ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে সব ক্ষেত্রই । তবে পর্যটন ক্ষেত্রে সেই আশা এখনও দুরস্ত । এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলি দিক । যতদিন না গণপরিবহন বা ট্রেন বা দূরপাল্লার বাসের স্বাভাবিক চলাচল শুরু হচ্ছে ততদিন স্বাধারণ মানুষ বেরোবেন না । চন্দনবাবু বলেন যে, "পাশাপাশি আর একটি বিষয় নিয়ে ট্রাভেল ও ট্যুরিজ়ম সংগঠনগুলি দেশজুড়ে সরব হয়েছে সেটা হল এক এক রাজ্যে স্বাস্থ্যবিধি বা COVID 19-এর বিষয় এক এক রকম নিয়ম মানা হচ্ছে । তাই দেশজুড়ে যাতে পর্যটকদের ঘোড়ার ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রণয়ন করা হয়, সেই দাবি জানানো হচ্ছে । দাবি জানানো হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও প্রয়োজনীয় নিয়ম মেনে পর্যটন শিল্প পুনরায় চালু না হলে বেকার হয়ে পড়বেন লাখ লাখ মানুষ।"
অন্যদিকে এখন ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম খুললেও একটি হ্যাশট্যাগ (#) মাঝেমধ্যেই চোখে পড়বে সেটা হল #staycay বা #staycation । অর্থাৎ বাড়ির থেকে কিছু দূরে একই শহরে একদিনের জন্য বা একটি গোটা দিনের জন্য কোনও হোটেল বা রিসোর্ট বা অন্য কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসা । বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এই নিউ নর্মাল যুগে হয়ত এই “স্টেক্যাশন”-ই অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পাবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে কোরোনা পরিস্তিতি স্বাভাবিক হলে সরকারি ও বেসরকারি পর্যটন শিল্পে আসতে পারে বড় রকমের পরিবর্তন। সেটিই হবে পর্যটন শিল্পের 'নিউ নর্মাল'। এবছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বিশ্ব পর্যটন সংস্থাগুলি লাভ হলেও কোরোনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ব্যাপক নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে । পর্যটন ব্যবসাকে চাঙ্গা করার জন্য ইতিমধ্যেই কেন্দ্র সরকারের কাছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে চিঠিও দিয়েছে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্যুর অপারেটরস । আশা ফের একবার আগের ছন্দে ফিরবে পর্যটন । ফের পিঠে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে হাতে ট্রলিব্যাগ নিয়ে প্রকৃতির টানে বা স্রেফ ঘোরার আনন্দ উপভোগ করতে শহরের বাইরে পা রাখার সাহস পাবেন মানুষ । সেই অপেক্ষাতেই এখন পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষরা ।