কলকাতা, 25 জুলাই : কোরোনা আবহে দফায় দফায় চলছে লকডাউন ৷ মোকাবিলায় জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব কিছুতেই জারি বিধিনিষেধ ৷ তাই বিগত চার মাস ধরে বন্ধ পঠনপাঠন ৷ শুধু স্কুল বা কলেজ নয়, বাধার মুখে মেডিকেল এডুকেশনও ৷ অনলাইনে থিওরি ক্লাস হলেও কোরোনার জেরে বন্ধ প্র্যাকটিকাল ক্লাস, ওয়ার্ডে ডিউটি ৷ প্রশ্নের মুখে বিভিন্ন স্ট্রিমের পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎও ৷ সব মিলিয়ে এই বাধার ফলে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষকেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । তবে, একই সঙ্গে তাঁরা মনে করছেন, সব থেকে আগে কোরোনার হাত থেকে উদ্ধার হওয়া প্রয়োজন ।
মেডিকেল এডুকেশনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন । স্নাতক কোর্সের পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে যেমন থিওরি, প্র্যাকটিক্যাল এবং ক্লিনিকাল ক্লাসের প্রয়োজন, স্নাতকোত্তর পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে তেমন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন । অথচ, এই দুই ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পড়ুয়া এবং জুনিয়র চিকিৎসকরা । কারণ, ওই সব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে কোরোনা হাসপাতাল হিসাবে চালু করেছে স্বাস্থ্য দপ্তর । যার জেরে, কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ইতিমধ্যেই বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন সেখানকার মেডিকেল পড়ুয়া ও জুনিয়র চিকিৎসকরা ।
অন্যান্য পড়াশোনার থেকে ডাক্তারি পড়াশোনা অনেকটাই আলাদা । এখানে লেকচার, প্র্যাকটিকাল ক্লাস এবং ক্লিনিকাল পোস্টিং, প্রতিটি বিষয় একই রকম গুরুত্বপূর্ণ । প্রতিদিন বেশ কয়েক ঘণ্টার লেকচার, প্রাক্টিকাল ক্লাস হয় । এটা কখনও কোরোনার এই সময় দিনে একটি বা দুটি লেকচারের মাধ্যমে সমান হতে পারে না । সাধারণ যে ট্রেনিং হয়, এই লেকচার তার সমান হয় না । কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ফাইনাল ইয়ারের পড়ুয়া প্রীতি গোস্বামী বলেন, "লেকচার, প্রাক্টিকাল, ওয়ার্ডে ক্লিনিকাল ট্রেনিং, এইশিক্ষা যদি সঠিকভাবে না হয়, তা হলে কীভাবে রোগ নির্ণয় করা হবে, কীভাবে চিকিৎসা হবে, সেটা জানা সম্ভব হবে না । মেডিকেল এডুকেশনে এই তিন ধরনের পদ্ধতি চলে আসছে এই কারণে যে, এই তিন ধরনের শিক্ষা পাওয়া সম্ভব হলে ভালোভাবে চিকিৎসা করা যায় । ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে আমাদের এখন ক্লাস হচ্ছে । অথচ, আমাদের পড়াশোনার বিকল্প কখনও ই-লার্নিং হতে পারে না । ই-লার্নিংয়ের সমস্যা হচ্ছে প্রথমত, এর মাধ্যমে খুব কম ক্লাস হচ্ছে । দ্বিতীয়ত, যাঁরা অনেক দূরে থাকেন বা যাঁদের অনেকে ইন্টারনেটের সিগনাল পান না, তাঁদের লাইভ আটকে যায় । এভাবে পড়াশোনা হতে পারে না ।"
কামারহাটিতে অবস্থিত কলেজ অব মেডিসিন অ্যান্ড সাগর দত্ত হাসপাতালের এক ইন্টার্ন চিকিৎসক নয়ন পাঠক বলেন, "কোরোনার এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো মেডিকেল এডুকেশনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । কোরোনা ব্যাপ্তির ফলে মেডিকেল কলেজগুলিতে ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না ।" তাঁদের দাবি, এই সময় কোনও বর্ষের পরীক্ষা নেওয়া চলবে না । কারণ, মেডিকেল এডুকেশন এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে অনলাইন ক্লাস যথেষ্ট নয় । প্র্যাকটিকাল বিষয়টি এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । আবার, কোনও রকম পরীক্ষা না নিয়ে যদি ডাক্তারি পড়ুয়ারা অন্য বর্ষে উত্তীর্ণ হয়ে যান, তা হলে মেডিকেল এডুকেশন এবং জনস্বাস্থ্যের পক্ষে তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক । কারণ, মেডিকেল এডুকেশন জীবনের সঙ্গে জড়িত । নয়ন পাঠক বলেন, "কোরোনা সংক্রমণ যখন কমতে থাকবে, তখন পরীক্ষা নিতে হবে । তার জন্য প্রয়োজনীয় থিওরি এবং প্র্যাকটিকাল ক্লাস করাতে হবে । এর জন্য যদি সেশন এক্সটেনশন করার প্রয়োজন হয়, তা হলে সেটা করতে হবে । এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের এন্ট্রান্স পরীক্ষাগুলিকে রিশিডিউল করতে হবে যাতে কোনও পড়ুয়া বঞ্চিত না হন । কোনও মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে সম্পূর্ণরূপে কোরোনা হাসপাতাল করে দেওয়া চলবে না । কারণ, এর ফলে মেডিকেল কলেজগুলিতে অনেক ইন্টার্ন, হাউজ়স্টাফ, স্নাতকোত্তর ট্রেনি (PGT) চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হবেন । কোরোনা আক্রান্ত ও কোরোনা আক্রান্ত নন এমন রোগীদের পাশাপাশি রাখতে হবে । এর জন্য নতুন পরিকাঠামো তৈরি যদি করতে হয় তাহলে এই মহামারী সময় এটা করতে হবে ।"
কোরোনা সংক্রমণ এবং লকডাউন ঘোষণার কারণে অন্যান্য শিক্ষার মতো মেডিকেল এডুকেশনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে । MBBS, নার্সিং, প্যারামেডিকেল, ডেন্টাল, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি-সহ মেডিকেল এডুকেশনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই চার মাস ধরে ক্লাস বন্ধ হয়ে রয়েছে । এই পর্বে বিভিন্ন সেমেস্টার, পরীক্ষাগুলি হওয়ার কথা ছিল, সেগুলি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে । যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, সেগুলি নিয়েও এখন অনিশ্চিত অবস্থা । যখন এ রকম অচলাবস্থা চলছে, তখন স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং গাইডলাইন পাচ্ছেন না ছাত্র-ছাত্রীরা । ছাত্রসংগঠন অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অর্গ্যানাইজ়েশন (AIDSO)-র সর্বভারতীয় স্তরের ভাইস প্রেসিডেন্ট, চিকিৎসক মৃদুল সরকার বলেন, "কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ । এ ক্ষেত্রে, অনলাইনে ক্লাস অনিয়মিত হচ্ছে । কোরোনার এই পরিস্থিতির মধ্যে কোনও মতেই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয় । যত দিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, তত দিন পরীক্ষা স্থগিত রাখতে হবে, এটা আমরা মনে করছি । পরীক্ষা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের যেভাবে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা অবৈজ্ঞানিক । থিওরি, প্র্যাকটিকাল, ক্লিনিকাল ক্লাস ছাড়া মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীদের যদি পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করে দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা কোনও কিছু শিখতে পারবেন না । যদি কিছু না শিখে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হন, তা হলে তাঁরা চিকিৎসক হিসাবে তৈরি হতে পারবেন না । প্রতি বছর এ রাজ্যে আড়াই হাজারের মতো মেডিকেল পড়ুয়া MBBS পাশ করে চিকিৎসক হয়ে ওঠেন । তাঁদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ যথাযথ না হলে, এর ফলে আখেরে আগামী দিনে সমস্যায় পড়বে সাধারণ মানুষ । সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই । ক্লাস এবং পরীক্ষার বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সুনির্দিষ্ট প্রোটোকল ঘোষণা করা দরকার । যখন সংক্রমণ কমতে শুরু করবে, তখন উপযুক্ত প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করে ক্লাসগুলি শুরু করা উচিত । পড়ুয়ারা যাতে সংক্রমিত হয়ে পড়তে না পারেন, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার । পরীক্ষা এমন সময় দেওয়া উচিত যখন ছাত্রছাত্রীরা শেষ করতে পারবেন । এর জন্য যদি অ্যাকাডেমিক সেশন এক্সটেন্ড করতে হয়, তাহলে এ বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে ।"