কলকাতা, 18 নভেম্বর : পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষার বেহাল অবস্থা বিভিন্ন সময়ে একাধিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে ৷ যদিও বেশিরভাগ সময়ে তৃণমূল বা পূর্বের বাম সরকার সরাসরি তা অস্বীকার করে এসেছে ৷
এবার আরও একটি বেহাল অবস্থার ছবি উঠে এল 2021’র অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্টে ৷ গতকাল তাদের সর্বশেষ সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলির অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভরশীল ৷ সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলির 76.5 শতাংশ ছাত্রছাত্রী, তা সে গ্রামাঞ্চল হোক বা শহরাঞ্চল, তারা পুরোপুরি প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভরশীল ৷ যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৷ এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পরেই রয়েছে এনডিএ শাসিত বিহার ৷ যেখানকার স্কুলগুলির 73.5 শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা নির্ভর করে প্রাইভেট টিউশনের উপর ৷
এই সমীক্ষা অনুযায়ী জাতীয় গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যান রীতিমতো উদ্বেগজনক ৷ জাতীয় গড় অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যার দেশের অনুপাতে 39.2 শতাংশ ৷ 2021’র অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্টের সমীক্ষা অনুযায়ী, এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভাল জায়গায় রয়েছে কেরালা, যেখানকার স্কুলের মাত্র 18.8 শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভর করে ৷ তবে, আর এক পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশার অবস্থা পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের তুলনায় কিছুটা ভাল ৷ ওড়িশার স্কুলগুলির 66.2 শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভর করে ৷ 2021’র অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্টের এই সমীক্ষা মোট 25টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের 75,234 স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে করা হয়েছে ৷
কেন পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের এই প্রাইভেট টিউশন নির্ভরতা ? এনিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. অমলকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে প্রাইভেট টিউশনের এই রমরমা ব্যবসার দু’টি কারণ ৷ প্রথমত, অভিভাবকরা অ-আ-ক-খ শেখানোর স্তর থেকেই ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাইভেট টিউটরের দ্বারস্থ হন ৷ তাই প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভরশীলতা স্কুল থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যায় এমনকি পিএইডি পর্যায় পর্যন্ত চলে ৷ দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে বেকার সমস্যার জন্য চাকরি না পেয়ে অনেকেই এই গৃহশিক্ষকতার কাজ করছেন ৷ তাই এই রাজ্যে প্রাইভেট টিউটর সহজলভ্য ৷’’
স্কুলের শিক্ষা নয়, রাজ্যের অধিকাংশ পড়ুয়া নির্ভরশীল প্রাইভেট টিউশনে অ্যাকাডেমিক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সুচিস্মিতা বাগচী সেন বলেন, ‘‘এই প্রাইভেট টিউশন নির্ভরতার একটা কারণ হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালে পরিবারের প্রথম প্রজন্ম যারা পড়াশুনা শিখছে, সেই সেইরকম ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ছে ৷ তাই তাদের অভিভাবকদের প্রাইভেট টিউশনের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে ৷ আর একটা কারণ হল বিশাল পাঠ্যসূচি শেষ করা ৷ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে যেটা মূল চ্যালেঞ্জ ৷ সেখানে বহুক্ষেত্রে সঠিকভাবে পড়ানোর একটা ঘাটতি থেকে যায় ৷ আর সবার মেধা যেহেতু সমান হয় না, তাই অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের বাধ্য হয়েই প্রাইভেট টিউটরের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে ৷’’
দিল্লি নিবাসী শিক্ষাবীদ চিরশ্রী দাশগুপ্ত মনে করেন, ‘‘এই প্রাইভেট টিউশনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শিশুমনের উপর খুব ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে ৷ আমি দিল্লিতে কুড়ি বছরের উপর শিক্ষকতা করছি ৷ কিন্তু, এখানে বা অনেক রাজ্যেই প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভরতা অনেক কম ৷ প্রাইভেট টিউশনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা অনেক সময় ছাত্রছাত্রীর চিন্তাভাবনার প্রবণতাকে হ্রাস করে ৷ তাই আমার অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন নিজেদের ছেলেমেয়েদের এই প্রাইভেট টিউশনের বৃত্তের বাইরে এনে তাদের নিজেদের মতো চিন্তাভাবনা করতে দেন ৷’’