কলকাতা, 16 অক্টোবর : আসব আসব করে শেষ পর্যন্ত পুজো এসেই গেল । সাম্বৎসরিক দুর্দশা-গ্লানি-কলুষ-দৈন্যের হাত থেকে ক’দিনের জন্য নিজেকে নিজেরই ছুটি দেওয়ার সময় এখন । এই ক’টা দিন বাঙালি স্মৃতিতে-ব্যস্ততায়-মিলনের আবহে নিজেকে জড়িয়ে নেবে । ক’টা দিনের জন্য এখন যেন আম-বাঙালির স্বপ্ন সফর । কিন্তু, সত্যিই কি স্বপ্ন সফর ? কোরোনা-লকডাউন-আমফান - একাধিক দুর্যোগ মাথায় নিয়ে শুরু হয়েছে দেবীপক্ষের । যদিও সেই দুর্যোগের ঘনঘটা কাটিয়ে শারদীয়ার আকাশ ঝলমলে থাকবে আশা এটাই । তবে পরিস্থিতি কিন্তু মোটেই স্বাস্থ্যকর ছিল না । ছিল কেবলই আশঙ্কা । আশঙ্কা । আর আশঙ্কা ।
কোরোনা পরিস্থিতিতে পুজো হবে কি না, তা নিয়ে ক্রমাগত বেড়েছিল সন্দেহ-সংশয়ের পারদ । লকডাউনের কালো মেঘ ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছিল কুমোরটুলির মতো প্রতিমা তৈরির 'কারখানাতে'ও । একটি বছরের পুজো শেষ হওয়ার পর পরই শুরু হয়ে যায় পরের বছরের তোড়জোড় । কোথায়-কোথায় পাঠানো হবে প্রতিমা, কাঠ-বাঁশ-খড়ের পরিবর্তে আর কী ধরনের আধুনিকতম উপাদন ব্যবহার করা হবে - এই সব নিয়ে শুরু হয়ে যায় ইস্তক আলোচনা । সময় যত এগোতে শুরু করে, কাজের-পরিকল্পনার-আলোচনার গতি ততই বাড়তে থাকে । কুমোরটুলির বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় কীভাবে পরিকল্পনার ধাপ কেটে কেটে কাজ এগিয়ে নিয়ে যান মাটির শিল্পীরা । সাধারণভাবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই ফি বছর দুর্গাপুজো হয়ে থাকে । তারপর কালী । কালীপুজোর পরই আগামী বছরের খাতা লেখা শুরু করে দেন তাঁরা । ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে পুরোদমে কাজে নেমে পড়েন । কিন্তু, সেই ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকেই বলতে গেলে হিমশীতল হতে শুরু করেছিল গোটা দেশ ।
মার্চ মাসের এক সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেন লকডাউনের । প্রথম দিকে আর পাঁচ জন বাঙালির মতো কুমোরটুলির সেই সময় মাটির কারিগররাও ভেবেছিলেন - বিষয়টি সাময়িক । কিন্তু, সময় যত এগোতে থাকে, পরিস্থিতি ততই জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করে । কোরোনা আতঙ্ক গ্রাস করতে শুরু করে ইদ-রথযাত্রা থেকে গণেশ চতুর্থীকে । নমো নমো করে সেরে ফেলা হয় এসব পার্বণ । এতদিন জমতে থাকা আশঙ্কা ধীরে ধীরে সত্যি হতে শুরু করে । মে-জুন মাসে যে কুমোরটুলি থাকে ব্যস্ততার শীর্ষে, সেখানে গ্রাস করে বেকারত্ব, কাজ হারানোর ভয় । পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুজো হচ্ছে বটে । কিন্তু, পরিবর্তন এসেছে কুমোরপাড়ার চালচিত্রে । যে কুমোরটুলি থেকে প্রতি বছরে বড় বড় প্রতিমা যেত, তার জায়গা নিয়েছে ছোটো দুর্গা । এর কারণ অবশ্যই বড় বড় পুজো কমিটিগুলোর হাত গুটিয়ে নেওয়া ।
বিধির বাঁধনেই মাটির শিল্পীদের স্বপ্ন সফর সম্পূর্ণ হবে একদিকে কোরোনা-লকডাউন । সঙ্গে দোসর আমফান । ফলে বড় বড় কমিটিগুলো বাজেট কাটছাঁট করতে শুরু করে । তার ঢেউ এসে পড়ে কুমোরটুলিতে । খরচ কমিয়ে ছোটো ছোটো প্রতিমা গড়ার দিকে ঝোঁকেন উদ্যোক্তারা । প্রতিমা শিল্পী বঙ্কিম পাল বলছেন, "এবছর পুজো উদ্যোক্তারা ছোটো দুর্গা প্রতিমাই চাইছেন । বর্তমান এই পরিস্থিতিতে পুজো করাটাই অনিশ্চিত ছিল । কমিটিগুলির হাতে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা না থাকলেও ছোটো প্রতিমাতে পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । তাই আর পাঁচটা বছরের থেকে এ বছর ছোটো দুর্গার অর্ডার বেড়েছে ।"
শুধু কলকাতা বা রাজ্য নয়, কুমোরটুলির প্রতিমা পাড়ি দেয় বিদেশেও । লন্ডন-অ্যামেরিকার মতো একাধিক দেশে কুমোরটুলির শিল্পীদের বেশ ভালোই কদর । এখানেও থাবা বসিয়েছে কোরোনা । ফি বছরে প্রতিমা যায় লন্ডনের হানস্লোতে ৷ শিল্পী প্রশান্ত পাল এই পুজোর প্রতিমা তৈরি করেন । এবছরও বায়না হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণার ফলে কাজ শুরু হলেও তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি । পরে পুজো কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এবছর পুজো হবে না । তাই বায়না হলেও এবছর আর লন্ডনের হানস্লোর উদ্দেশে রওনা দেবে না উমা । প্রশান্ত পালের মতো একাধিক বায়না হারিয়েছেন নিমাই পাল, সুজয় পালের মতো শিল্পীরা । পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর সাড়ে তিন হাজারের মতো দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয়েছিল কুমোরটুলিতে । বিদেশে গিয়েছিল 58টি ফাইবারের মূর্তি । দুর্গার পাশাপাশি 10-12 হাজার কালী মূর্তিও গড়েছিলেন তাঁরা । এবছর ছবিটা একেবারে আলাদা । প্রতিমা তৈরির কাঁচামাল (যেমন মাটি-বাঁশ-কাঠ-খড়-রং)-এর দাম বেড়েছে । সেই মতো দাম বাড়াতে পারছেন না শিল্পীরা । অর্থনীতির পরিচিত নিয়মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ-বছর যোগান আর চাহিদার মধ্যে কোনও মিল নেই কুমোরটুলিতে । স্বাভাবিক ভাবেই দিশেহারা তাঁরা । প্রায় ছয় মাস ধরে বিক্রিবাটা নেই । অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকার পুজোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা গিয়েছে । তবে, বিগত বছরগুলির মতো এ বছর বাজার মোটেই ভালো নয় । ছোটোখাটো করে হলেও পুজো হচ্ছে । এটাই একমাত্র আশার কথা ।
আশঙ্কা-সন্দেহ কাটিয়ে পুজো হচ্ছে । কিন্তু, এই সময়টা আরও একজোট হয়ে থাকার সময় । একে অন্যের দিকে আরও একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সময় । একই সঙ্গে অসুর (পড়ুন কোরোনা ) বিনাশের জন্য প্রয়োজনীয় সাহস সঞ্চয়েরও সময় । কখনও যেন অসুরের মুখোমুখি হওয়ার ভয় গ্রাস না করে । কেউ যেন ভুলে না যান, বছরভর নানা সম্প্রদায়ের নানা উৎসব যাতে নির্বিঘ্নে ও আনন্দে কাটে তার দায়িত্ব সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও । সবাই যেন বৃহত্তর আঙ্গিকে মস্ত বড় ভূমিকার কথা ভুলে না যান । তিমির বিনাশের সেই পথও আজকের দিনের ঐতিহ্যে রয়েছে । পরিস্থিতি বলছে, আজ-এখন আলিঙ্গনের দিন নয় । বিভেদবিলাসীদের পরাভূত করার সময় । সেই বিনাশেই নতুনের আমন্ত্রণ । নতুনের জয়গান । তাই শেষ হয়েও এ উৎসবের আবহের শেষ নেই । তা অনন্ত । তা অনাদি ।
নতুনের - উৎসবের বাতাসেও সতর্কতার মেঘ । চিকিৎসকরা বার বার সতর্ক করছেন । আনন্দ করলেও, তা অবশ্যই সীমিত পরিসরে - উপদেশ চিকিৎসকদের । আর তখনই কুমোরপাড়ার শিল্পীদের মুখে সামান্য হাসিই নতুন লড়াইয়ের বার্তা দিয়ে দিতে পারবে ।