কলকাতা, 23মে:এসএসসি দুর্নীতির একের পর মামলা নিয়ে সরগরম রাজ্য ৷ ধর্মতলার গান্ধি মূর্তির পাদদেশে 433 দিন ধরে ধর্না আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থী শিক্ষকরা এখন আশায় বুক বাঁধছেন । সৌজন্যে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Justice Abhijit Gangopadhyay)। যিনি এখন এসএসসি চাকুরিপ্রার্থীদের সামনে উপস্থিত ত্রাতার ভূমিকায় । যাঁর জেরে রাজ্যের মন্ত্রী-সান্ত্রীরা বিপাকে ।
জলি এলএলবি পার্ট টু সিনেমায় বিচারপতির ভূমিকায় অভিনয় করা সৌরভ শুক্লার একটি সংলাপ ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ইতিবাচক দিকটি তুলে ধরে । যেখানে তিনি বলছেন, মামলার পাহাড়ে ঢেকে থাকা আদালত যেন ভুলভুলাইয়া । তারই মধ্যে কোনও কোনও সময় এক একটি মামলা পুরো বিচার প্রক্রিয়াকে অক্সিজেন যোগায় । মামলাকারীরা বিচার ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস ফিরে পান ।
রিয়েল লাইফে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি মামলাটি (SSC Case latest news) সেই রকম একটি প্রশাসনের ঘুম উড়িয়ে নেওয়ার মতো মামলা । তবে শুধু এটাই নয়, সাম্প্রতিক কালে সবার নজর কেড়েছে আরও বেশ কিছু মামলার রায়দান ৷ আর সবেতেই উঠে এসেছে একটাই নাম ৷ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Interesting Career graph for Calcutta HC Justice Abhijit Gangopadhyay)৷ আম জনতা জানতে চায়, কে এই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ?
* বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কেরিয়ার শুরু করেছিলেন WBCS অফিসার হিসেবে । তবে পরে চাকরি ছেড়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি ।
* বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় 2018 সালের 2 মে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে নিযুক্ত হন । 30 জুলাই 2020-তে তিনি কলকাতা হাইকোর্টেরই স্থায়ী বিচারপতি হন ।
* প্রথম দিকে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির সঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চে ক্রিমিনাল (ফৌজদারি) বিভিন্ন মামলার বিচার করতেন । পরে একক বেঞ্চের বিচারপতি হন ।মূলত কোম্পানি সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলার বিচার করতেন । পরে করোনা আবহে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি তাঁকে আপার প্রাইমারি শিক্ষা বিষয়ক সমস্ত মামলার শুনানি করার দায়িত্ব দেন ।
* কর্মজীবনের শুরুতে প্রায় 10 বছর আইনজীবী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেছেন । তার মধ্যে ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্সের হয়ে মামলা লড়েছিলেন । তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এখন যে শিক্ষা বিষয়ে তিনি বিচারপতি, একসময় দীর্ঘদিন তিনি এই বিষয়েই স্কুল সার্ভিস কমিশন ও রাজ্য সরকারের হয়ে আইনজীবী হিসেবে লড়াই করতেন । আইনজীবীরা সেই কারণে বলেন, স্কুল সার্ভিস কমিশনের অন্দরমহল বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো এত ভালো কেউ জানেন না ।
আরও পড়ুন: Calcutta High Court :মাথায় বন্দুক ঠেকালেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচার থামবে না, এজলাসে বললেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
* 2016 সালের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দিয়ে তিনি প্রথম নজরে আসেন সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের । সময়টা ছিল 2021 সাল ৷ যদিও পরে সেই স্থগিতাদেশ তুলেও নেন ।
* এর পর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের বদলি সংক্রান্ত একাধিক মামলায় একের পর এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে আদালতে ডেকে জানতে চেয়েছেন কী কারণে বদলি আটকে রাখা হয়েছে । রাজ্যের স্কুলগুলিতে পরিচালন সমিতি ও প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে যে অশুভ আঁতাত রয়েছে বলে অভিযোগ, সেখানে সাংঘাতিক ভাবে আঘাত হেনেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় । ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, শিক্ষক বদলি প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছিল । বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একের পর এক শিক্ষক বদলির নির্দেশের পর রাজ্যের স্কুলগুলিতে শিক্ষক বদলির প্রক্রিয়া হঠাৎ করে থমকে গিয়েছে । টাকা পয়সার লেনদেন করতে সবাই ভয় পাচ্ছেন । সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুরের এক শিক্ষক এজলাসে দাঁড়িয়ে টাকা চাওয়ার বিষয়ে ফোনের কথোপকথন শোনান ।
* স্কুলের গ্রুপ ডি, গ্রুপ সি ও শিক্ষক নিয়োগে একের পর এক সিবিআই তদন্তের নির্দেশকে কেন্দ্র করে বিচারপতির সাহসী স্বচ্ছ ভাবমূর্তি সামনে চলে আসে ।বিচারপতির দেওয়া সিবিআই তদন্তের নির্দেশ যখন ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিত রাখতে বলে, তখন ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন তিনি । নজিরবিহীন ভাবে প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি পাঠিয়ে অভিযোগ করেন, "ডিভিশন বেঞ্চ তাঁর হাত বাঁধতে চাইছে ।" এই সময় তিনি আরও বলেন, “আমার মাথায় বন্দুক ঠেকালেও আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচার করব ।"
* বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিবিআই তদন্তের নির্দেশকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনে শাসকপন্থী ও বিরোধী দু-তিনটি শিবিরের মধ্যে মতবিরোধ তুঙ্গে । বিচারপতিকে বয়কট করার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিতর্ক দানা বাঁধে । এমনকী বার কাউন্সিলের ভিতর বিচারপতিকে বয়কট করার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে তৃণমূল-বিজেপি আইনজীবীদের মধ্যে নজিরবিহীন মারামারি, হাতাহাতি চলে । যার জেরে বেশ কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হন । তারপর বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় হাইকোর্টের ঐতিহ্য ভেঙে ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করছেন, এই অভিযোগে দীর্ঘ প্রায় এক মাস তৃণমূলপন্থী আইনজীবীরা সরব হন । বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ বয়কট করে মামলায় হাজির হওয়া বন্ধ রেখেছিলেন তাঁরা ।
* তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই সময় একের পর এক সাড়া জাগানো নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় । প্রথমেই 76 বছরের বৃদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা শ্যামলী ঘোষের চাকরি জীবনের প্রায় 25 বছরের বকেয়া বেতন রাজ্যকে দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি ।
* ক্যানসার আক্রান্ত আন্দোলনকারী চাকরিপ্রার্থী সোমা দাসকে দ্রুত বাংলা বিষয়ের শিক্ষিকা পদে নিয়োগ করার বিষয়ে রাজ্যকে ভাবার নির্দেশ দেন ।
* হুগলির ক্যানসার আক্রান্ত এক শিক্ষিকা ভেলোরে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন । সেই সময়ের বেতন কাটায় স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অবিলম্বে টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশের পাশাপাশি প্রধান শিক্ষককে চূড়ান্ত ভর্ৎসনা করেন । বলেন, "আপনি প্রধান শিক্ষক থাকার যোগ্যই নন ৷" পরে ওই প্রধান শিক্ষককে তাঁর পদ থেকে সরিয়েও দেন ।
আরও পড়ুন:Justice Abhijit Gangopadhyay: বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সমর্থনে বাবুঘাটে জমায়েত
* রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীকে বেআইনি ভাবে তাঁর মেয়েকে স্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে চাকরিতে নিযুক্ত করার অভিযোগে সিবিআই-এর দফতরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন । পাশাপাশি পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা ও 41 মাসের বেতন ফেরত দেওয়ার একের পর এক নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ।
* স্কুলের একাধিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নিযুক্ত উপদেষ্টা কমিটি যুক্ত থাকায় পার্থকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় । প্রয়োজনে পার্থকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে বলে নির্দেশ দেন ।
* কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাসে নজিরবিহীন ভাবে 18 মে মধ্যরাতে স্কুল সার্ভিস কমিশনের অফিসের নথিপত্র নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দেন তিনি ।
চোখে চশমা, মোটা গোঁফের রাশভারী মানুষ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ৷ না, আইনের বাইরেও তিনি আম আদমি । কাছের লোকেরা অবশ্য তাঁকে অন্য ভাবে জানেন । যেখানে তিনি মানবিক এবং নিরপেক্ষ, আইনের উপর ভরসা করে চলা মানুষ । পাশাপাশি হাসি মজা করতে ভালোবাসা রসিক মানুষ । তাঁর রায়ে কখনও রবীন্দ্রনাথ আবার কখনও সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা জায়গা পায় । বরেণ্যদের উদ্ধৃতি ধার করে রায় লেখেন তিনি ।
বহুদিন ধরে একজন মহিলা কর্মস্থলের স্থান বদল নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন । মহিলার ছেলে সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত । ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে প্রত্যেক 15 দিন অন্তর কলকাতায় এসে চিকিৎসা করাতে হয় । এই অবস্থায় বহুবার স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলা সত্বেও তাঁর বদলি আটকে ছিল । সেই মহিলা তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রুমের বাইরে দীর্ঘক্ষণ বসেছিলেন । অপেক্ষায় থাকতে দেখে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই তাঁকে ডেকে নেন এবং তাঁর সমস্ত কথা শুনে তাঁকে নায্য বিচার পাইয়ে দিয়েছিলেন । এ রকম প্রচুর “কেস ডায়েরি” রয়েছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ।
আইনের আঁকিবুকির বাইরে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বই পড়তে খুব ভালোবাসেন । বিভিন্ন বই পড়ার পরামর্শ দেন জুনিয়র আইনজীবীদের ৷ অন্যান্য আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ছবি প্রদর্শনী দেখতে যেতেও খুব ভালোবাসেন । দেখেই শেষ নয়, তা নিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে গল্প করেন ।
ইংরেজ আমলে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল থাকাকালীন তাঁর বন্ধু স্যার ইলাইজা ইম্পে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । রাজা নন্দকুমারের ফাঁসি ছিল তাঁর ঐতিহাসিক রায় । ব্রিটিশ হলেও বাংলার মাটি, গাছ-গাছালি, চিত্রকলা নিয়ে ছিল তাঁর প্রবল উৎসাহ । বাংলা, উর্দু এবং ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন ইম্পে । ন্যায়াধীশ মানেই রাশভারী মানুষ নন । তাঁদের মানবিক গল্প প্রচুর । ইম্পের ভাবমূর্তির ধারাই যেন বয়ে নিয়ে চলেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ।