কলকাতা, 20 জানুয়ারি: আজ প্রেসিডেন্সি কলেজের 203 তম প্রতিষ্ঠা দিবস । এই উপলক্ষ্যে একদিকে যখন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সংসদের দ্বারা আয়োজিত অনুষ্ঠান চলছিল, তখনই অন্যদিকে NRC, NPR, CAA-র বিরোধিতায় পোস্টার টাঙিয়ে স্লোগান তোলেন পড়ুয়ারা । তাঁরা একটি NRC, NPR, CAA বিরোধী সাক্ষর প্রচার শুরু করেন । সেখানে যেমন বর্তমান পড়ুয়ারা সাক্ষর করেন, তেমনই স্বতস্ফুর্তভাবে সাক্ষর করেন বহু প্রাক্তনীও । নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী, প্রসাদরঞ্জন রায়, প্রশান্ত রায়ের মতো প্রেসিডেন্সির একাধিক খ্যাতনামা প্রথিতযশা প্রাক্তনীরা স্বাক্ষর করেন ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরোজিও অডিটোরিয়ামে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী কৌশিকী দত্তচৌধুরি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধী কর্মসূচি নিয়ে বলেন, "আমরা সই সংগ্রহ করছি NRC, NPR , CAA-র বিরুদ্ধে । প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুল বোঝাচ্ছে । সবাই ভালভাবে নিচ্ছে না । বিরোধিতা করছে ।" রবিবার ডার্বির স্টেডিয়ামের গ্যালারিতেও দেখা গেছিল NRC, CAA-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ । আজ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসেও সেই একই প্রতিবাদ । তা নিয়ে কৌশিকী বলেন, "রাস্তা-ঘাটে, খেলার মাঠে, প্রেসিডেন্সির মধ্যেও NRC, NPR ও CAA-র মতো আইনের বিরোধিতা করছে । আজ প্রেসিডেন্সির একটি বড়দিনেও প্রাক্তনী সংসদের সবাই আমাদের পাশে রয়েছেন । অনেক বয়স্ক মানুষরা এসেও সই করে যাচ্ছেন । ভারতের সব মানুষ এক হয়ে বিরোধিতা করছে ।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরোজিও অডিটোরিয়ামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরোজিও অডিটোরিয়ামের ভিতরে প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান চলছিল । বাইরে প্রাক্তনী থেকে বর্তমান পড়ুয়ারা সকলে জমজমাট আড্ডার মেজাজে ছিল । আর তারই মধ্যে হঠাৎ স্লোগান ওঠে । প্রেসিডেন্সির খেলার মাঠে ঢোকার মুখেই পোস্টার টাঙানো ছিল 'নো NRC, NPR, CAA' লেখা । তারপাশেই ছিল একটি সাদা কাগজে মোড়া বোর্ড । যাতে NRC, NPR, CAA-র বিরুদ্ধে সাক্ষর সংগ্রহ করা হচ্ছিল । পড়ুয়াদের সঙ্গে স্বতস্ফুর্তভাবে সামিল হতে দেখা গিয়েছিল প্রাক্তনীদেরও ।
বিভাস চক্রবর্তী বলেন, "আমরা নাট্যকর্মীরা একটা মিছিল বের করেছিলাম, সমবেতভাবে একটা প্রতিবাদী অনুষ্ঠানও করেছিলাম । পাবলিককে কনফিডেন্সে নিয়ে তারপরে আইনটা প্রণয়ন করা উচিত ছিল । এটা গণতন্ত্র নয় । 38 শতাংশ ভোট নিয়ে চিরকালের জন্য আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে পারে না । দেশভাগের সময় ঠিক যেমনটা হয়েছিল । আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ দিল্লিতে বসে করে ফেলল এটা ঠিক করেনি । গণভোট হোক, হয়ে ঠিক হোক এই আইন গ্রহণীয় কিনা । কিন্তু ভোটাধিকারের দোহাই দিয়ে এইরকম মারাত্মক আইন পাশ করা যায় না ।"
আবার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র প্রসাদরঞ্জন রায় ছিলেন আজ । পশ্চিমবঙ্গ উচ্চশিক্ষা দপ্তরের প্রাক্তন অ্যাডিশনাল চিফ সেক্রেটারি সাক্ষরের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, "এই NRC, CAA ব্যাপারটা অদ্ভুত রকম তাড়াহুড়ো করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশের উপরে । রাজনৈতিক দলগুলো যারা এর পক্ষে অথবা বিপক্ষে তারা কেউ-ই এটা ঠিকমতো বোঝেনি । আজও এটার ইম্প্লিকেশন লোকে পুরোপুরি বুঝতে পারছে কিনা জানি না । আমি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বা পক্ষে কথা বলিনি । কাজ করেছি সরকারের জন্য । এখন বাধ্য হয়েছি । এর ফল কতটা ক্ষতিকারক তা আমি নিজেও নিশ্চিত নই । আমাদের জেনারেশনের লোকেদের বার্থ সার্টিফিকেট নেই । অথচ এখানে স্কুলে এসেছি, পড়েছি, স্কুলের সার্টিফিকেট দিয়ে সরকারি চাকরি করেছি এতো বছর । এরপরে যদি কেউ এখন বলে, তোমার পূর্বপুরুষের জমিজমার দলিল দেখাও, দেখাতে কিন্তু পারব না । আমি সবথেকে দুঃখিত, রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে হয়ে এটা প্রতিরোধ করতে পারছে না ।"
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে প্রাক্তনী থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রাক্তন অধ্যাপক তথা সমাজতত্ববিদ প্রশান্ত রায় বলেন, "আমার নিজের মনে হয় সভ্যতায় একটা বিরাট পরিবর্তন আসতে চলেছে । এই অবস্থাটাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যেটা ভারতীয় সংবিধানের মধ্যে ছিল না । ভারতীয় সভ্যতার পরিবর্তনের একটা দিক আছে, যেটা রাষ্ট্র আনতে চাইছে । এটা যতটা খোলামেলাভাবে বলা হয়েছে তার মধ্যেও একটা অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য রয়েছে । যেন লোককে দিয়ে সইয়ে নেওয়া হল একভাবে । এর অনেকগুলো ফলাফল আমরা বুঝতে পারছি না । যারা এটার সমর্থন করছেন তারাও হয়তো বুঝতে পারছেন না । অনেকের ভয় এটা কুফল হতে পারে । সেটা প্রিজুডিস হতে পারে । কিন্তু, দেখা গেছে যখনই সভ্যতাকে একটা অন্য কোনও মাত্রায় সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে তখনই অসম্ভব রক্তপাত হয়েছে । সেগুলো আমরা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি না । তাই এই প্রতিবাদ ।"
প্রেসিডেন্সি কলেজের পথচলা শুরু হয়েছিল 1817 সালের 20 জানুয়ারি । প্রতিষ্ঠা দিবসের উপলক্ষ্যে আজ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সংসদের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল একটি অনুষ্ঠানের । সেখানে প্রতিবছরের মতো এবছরও কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মানিত করা হয় বিভিন্ন পুরস্কার, মেডেল দিয়ে । এদিনই প্রাক্তনী সংসদের তরফ থেকে দেওয়া হয়ে থাকে অতুলচন্দ্র গুপ্ত বিশেষ প্রাক্তনী পুরস্কার । সেরা প্রাক্তনী হিসাবে এই সম্মান এই বছর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবীদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল । আজ বিশেষ কারণে প্রেসিডেন্সিতে না আসায় তাঁকে পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা করা হবে বলে জানালেন প্রাক্তনী সংসদ ।