কলকাতা, 10 জুন :বিশ্বায়নের যুগে আস্ত পৃথিবীটাকেই মুঠোয় পুরেছে মানুষ ৷ বদলে দূরে গিয়েছেন প্রিয়জনেরা ৷ একটা সময় পাড়া কালচারে অভ্যস্থ বাঙালি আজ বন্ধ ফ্ল্য়াটেই স্বচ্ছন্দ্য ৷ দরজার ওপারে গোটা সংসার রসাতলে গেলেও কুছ পরোয়া নেহি ৷ ততক্ষণে দরজার এপারে বিশাল এলইডি স্ক্রিনে সিরিয়ার যুদ্ধ ! তাই পাশের ঘরে শিকারি ওঁৎ পেতে থাকলেও হুঁশ হয় না আজকের বাঙালির ৷ আর হয়তো সেই কারণেই ঘটে যায় অবাঞ্ছিত ঘটনা ৷ নিউটাউনের সাপুরজি আবাসনে শুটআউট ও দুষ্কৃতী নিকেশের ঘটনায় এমন কারণই সামনে আনছেন মনোবিদরা ৷
কয়েক দশক আগেও বাঙালি ছিল যৌথ পরিবারের সদস্য ৷ একসঙ্গে রাঁধা, বাড়া, খাওয়া ৷ এটাই ছিল রেওয়াজ ৷ পাড়ায় পাড়ায় বসত বৈঠকী আড্ডা ৷ তার জন্য অবশ্য বৈঠকখানার দরকার হত না ৷ পাড়ার রোয়াকই ছিল যথেষ্ট ৷ এখনকার দিনে এই ছবি বিরল ৷ বেশিরভাগ পুরনো বাড়ি ভাঙা পড়েছে ৷ সেখানে উঠেছে বহুতল ৷ ফাঁকা জমি দখল করে মাথা তুলছে ঝাঁ-চকচকে আবাসন ৷ আর সেই সব ‘সুরক্ষিত’ ঘাঁটিতেই শিকর গাড়ছে অপরাধ ৷
বুধবার হঠাৎই সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে নিউটাউনের সাপুরজি আবাসন ৷ জানা যায়, এসটিএফের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে খতম হয়েছে দুই দুষ্কৃতী ৷ নিহতরা দু’জনেই দাগী আসামী ৷ তাদের নাম জয়পাল ভুল্লার ও যশপ্রীত জস্সি ৷ পঞ্জাব পুলিশের খাতায় দীর্ঘদিনের মোস্ট ওয়ান্টেড, পলাতক আসামী ৷
ড. তীর্থঙ্কর গুহঠাকুরতা, কেপিসি মেডিক্য়াল কলেজের অধ্যাপক আরও পড়ুন :বীরভূম-লিঙ্ক কাজে লাগিয়েই কেল্লাফতে রাজ্য গোয়েন্দাদের
প্রশ্ন উঠছে, এমন কুখ্যাতরা কীভাবে দিনের পর দিন গা-ঢাকা দিয়েছিল নিউটাউনের আবাসনে ৷ আর এখানেই সামাজিক বদলকে কাঠগড়ায় তুলছেন মনোবিদরা ৷ কেপিসি মেডিক্য়াল কলেজের অধ্যাপক ড. তীর্থঙ্কর গুহঠাকুরতা বলছেন, ‘‘আগে যে শুধুমাত্র পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি ছিল, তাই নয় ৷ এক পাড়ায় থাকা মানুষগুলোর মধ্যেও ছিল পারিবারিক সখ্য ৷ সবাই সবাইকে চিনতেন ৷ তাই অচেনা মুখ এলাকায় ঢুকলেও তার আড়ালে থাকা সহজ ছিল না ৷ কিন্তু এখন পরিস্থিতি উল্টো ৷ পাশের ফ্ল্য়াটে যাঁরা থাকেন, তাঁদেরই সকলকে চেনেন না প্রতিবেশী ! ফলে কে পাড়ার, আর কেই বা বেপাড়ার বোঝা দায় ৷’’
তীর্থঙ্কর বলছেন, ‘‘এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা ৷ আবাসন বা বহুতলে ফ্ল্য়াট ভাড়া করে থাকছে তারা ৷ গোপন আস্তানায় থেকেই চালিয়ে যাচ্ছে অপারেশন ৷ অথচ পাশের ঘরের বাসিন্দারা তা জানতেও পারছেন না ৷’’ প্রসঙ্গত, সাপুরজির আবাসনেও সুশান্ত দাস নামে এক দালালের মধ্যস্থতায় ঘর ভাড়া পেয়েছিল দুষ্কৃতীরা ৷ রফা হয়েছিল মাসিক 15 হাজার টাকায় ৷ আগাম দিতে হয়েছিল 25 হাজার টাকা ৷
রাজ্যশ্রী বন্দ্য়োপাধ্য়ায়, মনোবিদ তবে পুলিশের তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত আড়াল সরিয়ে সামনে আসতে হয় ফেরারদের ৷ প্রাণ যায় গুলির লড়াইয়ে ৷ এই জায়গাতেই আবাসনগুলির নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মনোবিদ রাজ্যশ্রী বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ৷ তাঁর মতে, ‘‘এটা ঠিক যে ফ্ল্য়াট কালচার এবং নিউক্লিয়ার ফ্য়ামিলির কিছু সুবিধা আছে ৷ এই ব্যবস্থা ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার পক্ষে আদর্শ ৷ কিন্তু এতে সামাজিকস্তরে পাস্পরিক দূরত্ব বাড়ে ৷’’
আরও পড়ুন :নিউটাউনের এনকাউন্টারে এনআইএ তদন্ত চান সৌমিত্র, চিঠি দিচ্ছেন শাহকে
এক্ষেত্রে আবাসনগুলির নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিদ্র হওয়া দরকার বলে মনে করেন রাজ্যশ্রী ৷ নিউটাউনের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ যেভাবে অপরাধীদের খুঁজে বের করেছে, তা প্রশংসনীয় ৷ তবে যে ফাঁক গলে অপরাধীরা এই আবাসনে গা-ঢাকা দিয়েছিল সেটা মেরামত করা দরকার ৷ ’’