পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / city

করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কারণ নেই, ভরসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা - করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হতে পরামর্শ চিকিৎসকদের

করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের থেকে নিজেদের দূরে রাখা উচিত। খুব কাছে বা ক্লোজ কন্ট‍্যাক্টসে যাওয়া উচিত নয়। গামছা, তোয়ালে, এই ধরনের জিনিস শেয়ার করা উচিত নয়‌। আক্রান্তকে পৃথক স্থানে রাখলে ভালো হয়‌।

Coronavirus Novel
করোনাভাইরাস নোভাল

By

Published : Jan 26, 2020, 4:35 AM IST

Updated : Jan 26, 2020, 5:55 AM IST

কলকাতা, ২৬ জানুয়ারি: নোভাল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খোঁজ বিভিন্ন দেশে পাওয়া যাচ্ছে । তেমনই এর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মধ্যেও । এ দিকে, নেপাল থেকে দার্জিলিঙে প্রবেশের জন্য পানিট্যাঙ্কি, মিরিক সীমানা এবং পশুপতি মার্কেটে নজরদারি বাড়ানোর জন্য শনিবার বিজ্ঞপ্তি জারি করে সতর্ক করে দিয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এবং কলকাতায় বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে নোভাল করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে চিকিৎসকরা বলছেন, আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবে, সাবধানতা অবলম্বন জরুরি।

নাম কেন নোভাল করোনাভাইরাস?

কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর মৌসুমি দত্ত বলেন, "এই ভাইরাস মূলত শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ঘটায়। সার্স-ও একটি করোনাভাইরাস। চিনে যে করোন ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ এর আগে কখনও মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি, সেই জন‍্য এই ভাইরাসকে নতুন বা নোভাল করোনাভাইরাস বলা হচ্ছে।" এর পাশাপাশি তিনি বলেন, "পশুদের থেকে মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। যে সব করোনা ভাইরাস এখনও মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি অথচ, পশুদের মধ্যে রয়েছে, সেই করোনা ভাইরাসগুলিও আগামী দিনে পশুদের থেকে মানুষের ছড়িয়ে পড়তে পারে। চিনে সংক্রমণের এই করোনা ভাইরাস যেহেতু নতুন, সেই জন্য এতটা তীব্র আকারে সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে।"

আর, করোনা ভাইরাস?

মুকুন্দপুরে অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালের মেডিসিন এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান, সৌরেন পাঁজা বলেন, "মাইক্রোস্কোপ, বিশেষ করে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে যদি দেখা হয় তা হলে সূর্য উঠছে তার সঙ্গে রশ্মি হয়েছে, ঠিক সেই রকম দেখতে এই ভাইরাস। এই জন্য একে করোনা ভাইরাস বলা হয়। সাধারণভাবে করোনা ভাইরাস দেখা যায় কমন ফ্লু-তে। এ ছাড়াও বিশেষ ধরনের করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের ঘটনা এর আগেও দেখা গিয়েছিল। যেমন, সার্স, মার্স।" মেডিসিন বিশেষজ্ঞ তপন বিশ্বাস বলেন, "করোনা ভাইরাস আমাদের রেসপিরেরেটরি সিস্টেমকে অ্যাটাক করে। এটা অন‍্য আর পাঁচটি সর্দি, কাশি, জ্বর-এর মতো দেখা দেয়। চিনে যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে, তার কম্প্লিকেশনস খুব দ্রুত এবং মারাত্মক ভাবে দেখা যাচ্ছে। এই ইনফেকশন এক ধরনের কমিউনিকেবল ডিজিজ়। সর্দি-কাশি, হাঁচির মাধ্যমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।" তিনি বলেন, "সাধারণ সর্দি-কাশির মতো বিভিন্ন উপসর্গ এই ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে। তবে বেশি সময় দিচ্ছে না। খুব দ্রুত ফুসফুস কিডনি হার্ট সহ বিভিন্ন অঙ্গকে অকেজো করে দিয়ে মারাত্মক আকার নিচ্ছে। এই জন্য মৃত্যু হচ্ছে।"

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কেন শুরু হল?

ডাক্তার সৌরেন পাঁজা বলেন, "অন্যান্য করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে যদি সেটা আমাদের শরীরে ঢুকে যায়, তাহলে আমাদের শরীরের ইমিউনিটি পাওয়ার সেটাকে ট‍্যাকল করে। কিন্তু এই বিশেষ ধরনের করোনা ভাইরাস, তাদের গঠন একটু অন্যরকম পুরোনো ভাইরাসগুলির থেকে। এই জন্য যখন সংক্রমণ ঘটছে তখন কোনও কোনও উপসর্গ জোরাল হচ্ছে। যে কারণে অনেক আক্রান্তকে গুরুতর অবস্থায় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে রাখতে হচ্ছে। এবং, তাঁদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে।"

উপসর্গ হিসাবে কী দেখা দেয়?

মৌসুমী দত্ত বলেন, "এই ভাইরাসে সংক্রমণের কারণে যে কোনও ধরনের সর্দি, কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়ার মতো শুরু হয়‌। এই ভাইরাস যেহেতু নতুন এবং, প্রতিরোধ-চিকিৎসার কোনও ওষুধ নেই, সেই জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে।" ডাক্তার সৌরেন পাঁজা বলেন, "এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে প্রথমে জ্বর হবে, নাক বন্ধ হয়ে যাবে, নাক দিয়ে জল পড়বে, কাশি হবে, গলা ব্যাথা হবে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিলে শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে। যার জেরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে। মৃত্যুও হতে পারে।" ডাক্তার তপন বিশ্বাস বলেন, "জ্বর হয়, মাথাব্যথা হয়, নাক দিয়ে জল পড়ে, সর্দি-কাশি এবং শ্বাসকষ্ট হয়।"

কীভাবে এড়ানো যেতে পারে এই ভাইরাসের সংক্রমণ?

মৌসুমী দত্ত বলেন, "করোনা ভাইরাসের জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। এমন কোনও অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ-ও নেই, যেটা এই ভাইরাস মেরে ফেলতে পারে, ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে পারে। করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধের অথবা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কোনও ওষুধও নেই। তাই প্রতিরোধ-ই একমাত্র উপায়।" তিনি বলেন, "যেহেতু এই ভাইরাস ফুসফুস বা শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়, সেজন্য যখনই কেউ হাঁচি বা কাশি দেবেন, মুখে রুমাল চাপা দিতে হবে। মাস্ক-এর ব্যবহার করা যেতে পারে। অসুস্থ মানুষের থেকে দূরে থাকতে হবে যাতে সর্দি-কাশি থেকে এই ধরনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে না পারে। বারে বারে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। সাবান দিয়ে অন্তত দুই মিনিট ধরে যদি হাতের তালু, চেটো, হাতের পিছনের দিকে, আঙ্গুলের ফাঁকে, আঙ্গুলের মাথায় ভালোভাবে ধোয়া যায়, তাহলে যে কোনও ধরনের জীবাণুর ৯০-৯৫ শতাংশ মারা যায়। দেখা গিয়েছে, এভাবে যে কোনও ধরনের রেস্পিরেটরি ইনফেকশন ছড়ানোর প্রবণতা অনেকটাই কমে যায়।" সৌরেন পাঁজা বলেন, "সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। এখনই ভয়ের কোনও কারণ নেই। তবে সাবধানের মার নেই। সেই জন্য আমরা যদি দেখি কোনও মানুষ বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফিরে এসে জ্বরের মধ্যে পড়লেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।"

আর কী সাবধানতা অবলম্বন করতে পারি?

করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের থেকে নিজেদের দূরে রাখা উচিত। খুব কাছে বা ক্লোজ কন্ট‍্যাক্টসে যাওয়া উচিত নয়। গামছা, তোয়ালে, এই ধরনের জিনিস শেয়ার করা উচিত নয়‌। আক্রান্তকে পৃথক স্থানে রাখলে ভালো হয়‌। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দিতে হবে।" সৌরেন পাঁজা আরও বলেন, "বিশেষ এই করোনা ভাইরাসের জন্য এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ দেওয়ার মতো রেকমেনডেশন নেই। সেই জন্য অ্যান্টিভাইরাল মেডিসিনের দরকার নেই। উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে।" তপন বিশ্বাস বলেন, "চিনের ওই প্রদেশের সঙ্গে কোনও সংযোগ রয়েছে, এমন কারও যদি এই ধরনের উপসর্গগুলি দেখা দেয়, এখান থেকে সেখানে কেউ গিয়েছেন অথবা, সেখান থেকে কেউ এসেছেন দুই সপ্তাহের মধ্যে তাহলে অবশ্যই তাদেরকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।" তিনি বলেন, "যিনি আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁর থেকে যাতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তার জন্য তাঁকে ১০-১৪ দিন আইসোলেশনে রাখতে হয়। উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করা হয়। যেমন, জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল, শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেন দেওয়া। এক্ষেত্রে কোন অ্যান্টিবায়োটিক বা, অ্যান্টি-ভাইরাল মেডিসিন দেওয়ার জন্য রেকমেন্ডেশন নেই। কিন্তু উপসর্গ যদি বেশি আকারে দেখা দেয়, সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন প্রিভেন্ট করার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।"

চিকিৎসকরা বলছেন, আতঙ্কিত হবেন না। তপন বিশ্বাসের কথায়, "আতঙ্কের কোন কারণ নেই। আমরা যারা সাধারণ মানুষ এখানে বসবাস করছি, তাঁদের ক্ষেত্রে এই উপসর্গগুলি দেখা দিলে, সাধারণভাবে চিকিৎসা করা হবে।" কামারহাটির কলেজ অফ মেডিসিন অ্যান্ড সাগর দত্ত হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান, পলাশ দাস বলেন, "ইউহান শহরে গোটা পৃথিবী থেকে অনেক মানুষ যান। প্রায় এক কোটি মানুষ সারা বছর ওই শহরে যাওয়া-আসা করেন। বাতাসের মাধ্যমে শ্বাসনালীর মধ্য দিয়ে এই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গির জীবাণু বহনকারী মশা না কামড়ালে ডেঙ্গির ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটবে না। তবে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাসগুলি যখন বাতাসের মধ্যে থাকে তখন মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখানে একজন মানুষের ফুসফুস থেকে অন্য মানুষের ফুসফুসের মধ্যে রয়েছে বাতাস। তাই অন্য কোনও মাধ্যমের দরকার নেই। যিনি আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁর কাছে যদি আক্রান্ত হননি এমন কেউ যান, তাহলে শ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করবে এই ভাইরাস।"

তিনি বলেন, "সংক্রমণ ঘটাতে ঘটাতে এই ধরনের ভাইরাসের তেজ কমে আসে। এর ফলে আপনা থেকেই রোগের প্রাদুর্ভাব কমে আসতে থাকে। এটা ভালো দিক। তবে, এর উলটোটাও হতে পারে। শরীরে সাধারণ একটি ভাইরাস ঢুকল, দেখা গেল আরও ক্ষতিকারক ভাইরাস হিসাবে তা বেরিয়ে এল। এ ক্ষেত্রে নতুন ধরনের ভাইরাসের পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।"

করোনা ভাইরাস আমাদের এখানে প্রায়-ই হয়ে থাকে।

কীভাবে হয়?

সৌরেন পাঁজা বলেন, "সর্দি, কাশি হয়, দুই-তিন দিন জ্বর থাকে। এগুলিকে আমরা কমন ভাইরাল ফিভার বলি। গলা ব্যথা, হাঁচি, কাশি হয়। কোনও ক্ষেত্রে দেখা গেল কাশি হয়তো চার-পাঁচদিন থাকল, তার পরে ভাল হয়ে যায়। এর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিভিন্ন ভাইরাস হয়, তার মধ্যে করোনা ভাইরাস একটি। যদিও অধিকাংশ সময় এই করোনা ভাইরাসে আমরা আক্রান্ত হই। কিছু কিছু সময় দেখা গিয়েছে, ভাইরাল ফিভার, যেমন সোয়াইন ফ্লু বিশেষ ধরনের ইনফুয়েঞ্জা। চিনে এবার যেটা দেখা গিয়েছে, এটা বিশেষ ধরনের করোনা ভাইরাস‌।"

Last Updated : Jan 26, 2020, 5:55 AM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details