কলকাতা, 20 সেপ্টেম্বর :সিন্ধু সভ্যতা (Indus Valley Civilisation) নিয়ে উৎসাহের খামতি নেই আমজনতার ৷ দাবি, পাল্টা দাবির লড়াইয়ে আজও প্রকৃত ইতিহাসের বেশিরভাগটাই অধরা ৷ তার প্রধান কারণই হল সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত লিপি নিয়ে আজকের মানুষের অজ্ঞতা ৷ যদিও প্রাচীন এই লিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন বিশেষজ্ঞরা ৷ সেই প্রচেষ্টার মধ্যেই সিন্ধু সভ্য়তার ভাষা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এক বঙ্গতনয়া ৷ তাঁর নাম বহতা অংশুমলী মুখোপাধ্যায় ৷ তাঁর মুখোমুখি হলেন ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি ৷
ইটিভি ভারত : কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করেও প্রাচীন ভাষা নিয়ে গবেষণার কারণ কী ?
বহতা: আমি পেশায় সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হলেও ছোট থেকেই আগ্রহ ছিল ইতিহাস নিয়ে ৷ সেই আগ্রহ আরও বেড়ে যায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক রণজয় অধিকারীর সান্নিধ্যে ৷ সেই থেকেই সিন্ধু সভ্যতার ভাষা নিয়ে গবেষণা শুরু করি ৷ পরে নানা কারণে একাই সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই ৷ প্রতি মুহূর্তে এমন সব তথ্য উঠে আসে, তাতে গবেষণা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ৷
ইটিভি ভারত : 2021 সালের 3 অগস্ট আপনার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ৷ সেটির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল ৷
বহতা : শুধুমাত্র এই পেপারটির জন্য বেশ কয়েকশো বই ও গবেষণাপত্র পড়তে হয়েছিল আমাকে ৷
ইটিভি ভারত : গবেষণার কেন্দ্র হিসাবে সিন্ধু সভ্যতাকেই বেছে নিলেন কেন ?
বহতা : সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আমরা, মানে ভারতের প্রত্যেকটি প্রান্তের মানুষই কোনও না কোনওভাবে জড়িয়ে আছি ৷ যোগাযোগের সেই অংশীদারিত্ব কিছু কম বা বেশি হতে পারে ৷ কিন্তু, আমরা সকলেই আদতে একই সূত্রে বাঁধা ৷
ইটিভি ভারত : সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার হয়নি ৷ তাহলে গবেষণার কাজে এগোলেন কীভাবে ?
বহতা : সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দারা ব্যবসায় পটু ছিলেন ৷ মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে নিয়মিত বাণিজ্য হত তাঁদের ৷ সিন্ধু সভ্যতার লিপি আজও মৌন থাকলেও, মেসোপটেমিয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটা নয় ৷ সেখানকার লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে বলে সেখানকার অজস্র লিখিত উপাদানের থেকে তখনকার মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস এবং তাদের সঙ্গে যেসব সভ্যতার যোগাযোগ ছিল তাদেরও খণ্ডিত ইতিহাস আমাদের কাছে উঠে আসে। ৷ আমার যুক্তি হল, ব্যবসায়িক আদানপ্রদান হলে ভাষারও আদানপ্রদান অবশ্যম্ভাবী ৷ গবেষণায় তার প্রমাণও হাতে পেয়েছি আমি ৷ যা থেকে এটা স্পষ্ট, আজ যাঁরা দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, তাঁদের পূর্বপুরুষরাও সিন্ধু সভ্যতার অংশ ছিলেন ৷ অর্থাৎ দ্রাবিড় ভাষার ভিত সিন্ধু সভ্যতার গভীরেই রয়েছে ৷
সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ ৷ ইটিভি ভারত : এই সংযোগ কীভাবে সামনে এল ? সেটা যদি একটু সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেন ৷
বহতা : মেসোপটেমিয়ার মানুষ হাতির দাঁত ব্যবহার করতেন ৷ কিন্তু, হাতি তাঁদের নিজস্ব পশু ছিল না ৷ অর্থাৎ, হাতি বা হাতির দাঁত তাঁরা অন্য দেশ থেকে আমদানি করতেন ৷ হাতিকে তাঁরা বলতেন ‘পিরু’। আবার প্রাচীন পারস্যে হাতির দাঁতকে বলা হত ‘পিরুস’ ৷ এছাড়া, সিন্ধু সভ্যতায় একটি গাছের সন্ধান পাওয়া যায় ৷ যার ডাল দাঁতন হিসাবে ব্যবহার করা হত ৷ তার নামও ‘পিরু’ ৷ এর থেকে প্রমাণিত হয়, যে ‘পিরু’ শব্দের খোঁজ মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া গেলেও তার উৎস আদতে সিন্ধু সভ্যতা ৷ আর সেই শব্দের ভারতীয় রূপ হল পিলু, যা আজও নানান ভারতীয় ভাষার অভিধানে বর্তমান। মজার বিষয় হল, আজও দক্ষিণ ভারতে গণেশ ঠাকুরকে ‘পিল্লাইয়ার’ বলা হয় ৷ এই শব্দেরও উৎস সেই সিন্ধু সভ্যতা ৷
ইটিভি ভারত : খনন কার্যে সিন্ধু সভ্য়তার নানা নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে ৷ সেগুলি সম্পর্কে যদি একটু বলেন ?
বহতা: গবেষণার কাজে নেমে আমার নজর কেড়েছে কিছু সিলমোহর এবং ট্যাবলেট ৷ এগুলির উপর নানা ধরনের ছবি ও লিপি আঁকা আছে ৷ আমার ধারণা, ব্য়বসার উদ্দেশ্যে পণ্য পরিবহণের সময় এই সিলমোহর ব্যবহার করা হত ৷ নরম মাটির উপর এগুলি দিয়ে ছাপ মারা হত ৷ লিপিগুলি বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্য বহন করে । আর পশুর ছবি ইত্যাদি, সেইসব সিলমোহর যেসব সংস্থা রুজু করত তাদের পরিচয় বহনকারী চিহ্ন । যেমন আমাদের ভারতীয় মুদ্রার উপরে অশোকস্তম্ভের ছবি জাতীয় চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয় ৷ আমার ধারণা, এগুলির মাধ্যমে কর আদায় করা হত ৷ এছাড়া, ট্য়াবলেটগুলিও ব্যবসার কাজে লাগানো হত ৷ আমার তত্ত্ব বলছে, এই ট্য়াবলেটগুলি আসলে ‘ট্রেড পারমিট’ বা ব্যবসার ছাড়পত্র ৷
ইটিভি ভারত: আপনার কী মনে হয়, আপনার এই গবেষণা আজকের মানুষের কাজে কীভাবে লাগবে ?
বহতা : বিভিন্নতার মধ্যে একাত্ম হওয়াই ভারতের ঐতিহ্য ৷ কিন্তু, রাজনীতি করতে গিয়ে আমরা সেসব ভুলে যাচ্ছি ৷ সবাই নিজেকে শ্রেষ্ঠ আর বাকিদের তুচ্ছ মনে করে ৷ কিন্তু, এই ভাবনা অমূলক ৷ ইতিহাস বলছে, সিন্ধু সভ্যতা থেকে মানুষ পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে গিয়েছেন ৷ আমাদের সকলের শিকড়ই আছে সিন্ধু সভ্যতার গভীরে ৷ তাই এই হানাহানি অবান্তর ৷ আশা করি, এই গবেষণা সেটা দেশবাসীকে উপলব্ধি করাতে সহায়তা করবে ৷
এই সংক্রান্ত খবর : কোভিশিল্ড গবেষণায় মথুরাপুরের শুভাশিসকে পুরস্কার ভারত সরকারের