কলকাতা, 3 অক্টোবর : পুজোয় হতে পারে বৃষ্টি । আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী তাই সঙ্গে শুধু ছাতা বা বর্ষাতি রাখা নয়, ঘরে-বাইরের খাবারের মধ্যেও রাখতে হবে সামঞ্জস্য । না হলে, মাটি হয়ে যেতে পারে পুজোর আনন্দ । তাহলে কীভাবে সুস্থ থাকবেন পুজোর সময়? সে সব নিয়ে কথা বললেন চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী । দিলেন ভালো থাকার টিপস ।
বৃষ্টির সঙ্গে রোগের যেটা সম্পর্ক তা হল, বৃষ্টিতে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণের তারতম্য ঘটে । এটাই বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল ইনফেকশন ডেকে আনে । একথা জানিয়ে চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "পুজোর সময় যখন কেউ বাইরে বের হচ্ছেন সেজেগুজে নতুন জামাকাপড় পরে অনেকেই সঙ্গে ছাতা বা বর্ষাতি নিতে চান না । কিন্তু, এ বার যে রকম পরিস্থিতি, তাতে এগুলো সঙ্গে রাখাই বাঞ্ছনীয় । না হলে, হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সঙ্গে সঙ্গে কোনও ছাউনি পাওয়া যাবে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই । এর ফলে বৃষ্টিতে ভিজে যেতে পারেন । আর এই ভেজা অবস্থায় অনেকক্ষণ ঘুরতে হতে পারে । যাতে গায়ে জল শুকোবে । এর জন্য ঠান্ডা লেগে যাবে অর্থাৎ ভাইরাল ইনফেকশন হবে । এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে, একদিকে আর্দ্র আবহাওয়া অন্যদিকে ভিড়ের মধ্যে আপনি ঘুরছেন । আশপাশে অনেক মানুষ রয়েছেন তাঁদের মধ্যে কারও যদি ভাইরাল ইনফেকশন থাকে, তা হলে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সেগুলি বাতাসে ভাসমান কণার মাধ্যমে আপনার মধ্যে চলে আসতে পারে । ফলে খুব সহজেই ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । এর ফলে ছাতা, বর্ষাতি নিয়ে যদি বেরোতে না ইচ্ছা করে, তা হলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগুলি নিয়ে বের হন । না হলে পুজোর আনন্দ মাটি হতে পারে ।"
পুজো মানেই বাঙালির পেটপুজো । বছরে আর পাঁচটা দিন যেমন খাওয়াদাওয়া হয় তার থেকে অনেক বেশি খাওয়ার প্ল্যান থাকে পুজোর সময় । এর মধ্যে আবার ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুডের প্রাধান্যই বেশি থাকে । একথা জানিয়ে কৌশিকবাবু বলেন, "খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে একটু বাছবিচার করে চলা বাঞ্ছনীয় । মানে দিনে তিন বেলা বাইরে খেয়ে নিলাম, এটা না করে যদি যেকোনও দিনের একটা যেকোনও সময় বেছে নেওয়া হয় বাইরে খাওয়ার জন্য আর বাকিটা হালকা খাবার খাওয়া হয় তাহলে শরীর ভালো থাকবে ।"
কেন বাইরের খাবার খাওয়া উচিত নয়? এই চিকিৎসক বলেন, "বাইরের খাবার যিনি বানাচ্ছেন তাঁর উদ্দেশ্য আপনাকে রসনায় তৃপ্ত করা । আপনার জিভ-মনকে আনন্দ দেওয়া । আপনার শরীর ভালো রাখার কোনও দায়িত্ব তাঁর নেই । পুজোর সময় তাঁরা খাবার অনেক বেশি পরিমাণে বানাচ্ছেন কারণ চাহিদা অনেক বেশি । এই পরিস্থিতিতে খাবারের গুণগত মান বজায় রাখা দোকানগুলোর পক্ষে একটু কঠিন । আর এই সময় রাস্তার খাবার-দাবারে এমন অনেক জিনিসপত্র মিশে যায়, যেগুলো আমাদের শরীরের পক্ষে ভালো নয় । যেমন, বিভিন্ন ধরনের কুলফি । যাতে বরফ দেওয়া হয় । বরফগুলি কীভাবে আসছে, কীভাবে তৈরি করা হচ্ছে, এর গ্যারান্টি কেউ আপনাকে দিতে পারবে না ।"
কৌশিকবাবু আরও বলেন, "তিন বেলা যদি বাইরের খাবার খান, বাইরের খাবার খাওয়া মানে বেশি তেল দিয়ে বানানো বা রিচ খাবার । রিচ খাবার আপনার শরীরের খাদ্যনালী, পাচনতন্ত্রের উপর চাপ ফেলবে । এর পরে একদিন খাওয়ার জন্য দু'দিন অসুস্থ হয়ে পড়লে, পুজোর আনন্দ মাটি হয়ে যাবে । এর থেকে এক বেলা বাইরে খাওয়া, একবেলা বাড়িতে খাওয়া বা সঙ্গে খাবার রাখা কিংবা হালকা খাবার খাওয়া উচিত । এক বেলা ননভেজ খাওয়া হল, অন্য বেলা ভেজ খেলাম । একবেলা সাউথ ইন্ডিয়ান খেলাম হালকার উপর, অন্য বেলা নর্থ-ইন্ডিয়ান খেলাম । এরকম ভাবেও শরীর ঠিক রাখা যেতে পারে ।"
তবে, শুধুমাত্র খাবার নয় । পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরোলে পানীয় জলের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে । যেখান সেখান থেকে জল না খাওয়াই ভালো । এবিষয়ে কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "বেরোচ্ছেন ঠাকুর দেখতে ? সঙ্গে অনেক জল কিন্তু রাখতে হবে । কারণ বিভিন্ন প্যান্ডেলের ঠাকুর দেখতে অনেক হাঁটতে হবেই । কোথাও গাড়ি করে প্যান্ডেলে পৌঁছানোর উপায় নেই । পুজোর সময় মানুষ কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে ফেলেন । এই হাঁটার দৌলতে শরীরের অনেক ক্যালোরি খরচ হয় । সঙ্গে অনেকটা জল বেরিয়ে যায় । এর ফলে ডিহাইড্রেশন হয়ে যায় শরীরে । তাই সঙ্গে যদি জল রাখা হয় তাহলে রাস্তার জল, শরবত, এসবের দরকার পড়বে না । রাস্তায় তৈরি শরবতের জল কোথা থেকে আসছে, আপনি জানেন না । আপনার পক্ষে সেটা খুঁজে বের করা মুশকিল । নামকরা হোটেলেও যে সব কিছুর গুণগত মান বজায় রেখে করা হচ্ছে, সেই গ্যারান্টি আপনাকে কতজন দিতে পারবেন । আর জল তো বেশি করে খেতেই হবে । কারণ গরমে ঘামে অনেক নুন বেরিয়ে যায় শরীর থেকে । নুন মেশানো জল খেলে তো আরও ভালো হয় । বাড়ি থেকে শরবত বা নুন-চিনির জল মিশিয়ে নিয়ে বেরোতে পারেন ।"
সাধারণত দিনেরবেলা ঠাকুর দেখার পরে আসে রাত জেগে ঠাকুর দেখা । এক্ষেত্রে কিন্তু চিকিৎসক বলেন, "টানা বেশ কিছুক্ষণ পরিশ্রমের পর একটু বিশ্রামের দরকার হয় । ঠাকুর দেখবেন, কিন্তু নিজের শরীর বুঝে । যখন খুব পায়ে ব্যথা হচ্ছে, পায়ে টান দিচ্ছে বা শরীর আর দিচ্ছে না, তখনও জোর করে নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে হবে এমন কিন্তু কেউ আপনাকে মাথার দিব্যি দেয়নি । শরীর বজায় রেখে করতে পারেন । এমন বহু মানুষ আছেন কর্মসূত্রে যারা সারারাত কাজ করেন । এর ফলে রাত জেগে থাকা, রাত জেগে ঠাকুর দেখায় অনেকে অভ্যস্ত । অনেককেই রাত জাগতে হয় । রাত জাগাটা সমস্যা নয়, সমস্যা হল যদি শরীর যথেষ্ট বিশ্রাম না পায় এবং ঠিকঠাক খাবার, ক্যালোরি এবং জল না পায় ।"
সবকিছু মেনে চলুন । তারপরও যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত । কারণ? কৌশিকবাবু বলছেন, "পুজোর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্য সময়ের মতো একটু দেখলাম, এমন করা উচিত নয় । ধরুন ভাইরাল ইনফেকশন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে । দু'দিনে বা তিন দিনে জ্বর কমে যাবে বলে ভাবছেন । পুজোর মধ্যে সেই রিস্ক নেওয়া উচিত নয় । তাড়াতাড়ি কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত । কারণ, পুজো যে সময় হচ্ছে এবং সঙ্গে আবহাওয়া যেরকম হয়ে আছে, এখন আমরা ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া সব কিছুই পাচ্ছি । এবং, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা অনেক । গত বছর পুজোর সময় ম্যালেরিয়ার অনেক রোগীকে দেখা গেছে । এবারও হয়তো দেখা যেতে পারে । এর ফলে একটু সমস্যা হলেই তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো । রাস্তায় পুজোর জন্য যেমন যানজট থাকে এবং চিকিৎসকেরা অনেকে ছুটিতেও থাকেন তাই চিকিৎসায় যাতে কোনও ঘাটতি না হয় সেজন্য তড়িঘড়ি পদক্ষেপ করা উচিত ।"
আর জ্বর হলে কী করবেন ? চিকিৎসকের পরামর্শ, "হালকা জ্বর হচ্ছে, গা ব্যথা করছে, এক্ষেত্রে খুব ভালো এবং নির্ভরযোগ্য ওষুধ বলতে পারি প্যারাসিটামল এবং অনেক জল । ভাইরাল ফিভারেও মূল চিকিৎসা হল বিশ্রাম, জল, জলের সঙ্গে ব্লাড প্রেসার যদি কমে যায় তাহলে একটু নুন মেশানো জল বা ORS । তিন বার প্যারাসিটামল খেলে গা-হাত-পা ব্যথা, জ্বর সবই কন্ট্রোলে চলে আসে । হালকা ভাইরাল ফিভারে শুধু এই ব্যবস্থাতে বাড়িতে রেস্ট নিয়ে সেরে যায় । ছোটোদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য । ছোটোরা বাইরের খাবার খেতে চাইবে । তাদেরকে একটু লাগাম টেনে রাখাটা বড়দের দায়িত্ব । ছোটোদের শরীরের অনুপাতে জলের মাত্রা বজায় রাখা, ঠিকঠাক খাবার এবং বিশ্রামে রাখা প্রয়োজন ।"