আজকের মতো থিম পুজোর ভিড় তখন একেবারে ছিল না । কেমন ভাবে কাটত তখনকার পুজো ? নিজেদের ফেলে আসা দিনের পুজোর স্মৃতি ETV ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও কবি সুবোধ সরকার ।
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
আমি যে অঞ্চলে বড় হয়েছি তা ছিল কলকাতার কাছেই একটি প্রাচীন গ্রাম ৷ গ্রামটির নাম বরাহনগর ৷ একেবারে গঙ্গার উপর ৷ বিপরীত দিকে বেলুড়মঠ ৷ জায়গাটি ছোটো হলেও প্রচুর ইতিহাস ৷ বহু বিশিষ্ট মানুষ এখানে বসবাস করেছেন ৷ একসময় কলকাতার ঠাকুর পরিবারের সারি সারি বাগানবাড়ি ছিল গঙ্গার ধারে ৷ এখনও আছে, মৃয়মান অবস্থায় ৷
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কলকাতার জয়নারায়ণ মিত্র ৷ তিনি এখানে উদ্যান সমন্বিত একটি কালীবাড়ি স্থাপন করেছিলেন ৷ এখনও আছে ৷ এই কালীবাড়ি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি থেকেও 5 বছরের প্রাচীন ৷ এই কালীবাড়িতে একসময় স্বামী বালানন্দজি (স্বামী মোহনানন্দজির গুরু ৷ মস্ত বড় সাধক ৷ দেওঘরে যাঁর তপোবন ৷) থাকতেন ৷ তখন পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের খ্যাতনামা সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন ৷ আবার মাইকেল মধুসূদন দত্তও এই কালীবাড়ির গেস্ট হাউজ়ে ছিলেন ৷ এইখানেই তিনি গঙ্গায় স্নান করে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বলেছিলেন, আজ থেকে আমি হিন্দু হলাম ৷ এইরকম একটি জায়গায় আমার বড় হওয়া ৷ একদিকে শিক্ষিত মানুষ, ধনী মানুষ, যাঁদের মধ্যে একাধিক রায়বাহাদুর ৷ আরেক দিকে সাধারণ বৃত্তিজীবী প্রান্তিক মানুষের দল ৷ এখানে সাধনসমরের মহর্ষি সত্যদেব একটি আশ্রম স্থাপন করেছিলেন ৷ এদের দুর্গাপুজোর পদ্ধতি ছিল অসাধারণ ৷ সন্ধিপুজোর পূর্বে তিনি নিজে হাতে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে মাকে স্নান করাতেন ৷ অলৌকিকত্ব এইখানেই যে মাটির তৈরি প্রতিমা কিন্তু গলে যেত না ৷ এই পূজায় পূজারী ও দর্শনার্থীর মধ্যে কোনও ভেদ থাকত না ৷ সকলেই একসঙ্গে পূজায় বসতেন ৷ সমবেত মন্ত্র উচ্চারণ ও সংগীত হত ৷ এই পূজাটি দেখার জন্যে মানুষ উদগ্রীব হয়ে থাকতেন ৷ এই পূজাটিই ছিল বলবার-কইবার মতো ৷ এছাড়াও প্রাচীন ঐশ্বর্যশালী পরিবারগুলির পারিবারিক পূজা তো ছিলই ৷ পূজা হত নাটমন্দিরে ৷
আমার ছেলেবেলায় যুগ যখন আধুনিক হচ্ছে ক্রমশ, তখনই সর্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হল ৷ এবং একটা মজার কথা, দুটি আকর্ষণীয় বড় পূজার উদ্যোক্তা ছিলেন দুই শিল্পপতি ৷ একটি পূজা হত বেঙ্গল ইমিউনিটিতে (ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতিষ্ঠিত ওষুধ তৈরির কম্পানি ৷) ভ্যাকসিন তৈরির জন্যে বিখ্যাত হয়েছিল ৷ শত শত কর্মী কাজ করতেন ৷ এদের ছিল বিরাট কারখানা এবং আবাসন ৷ যা আজ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে ৷ স্থানীয় মানুষ এই বেদনা এখনও ভুলতে পারেনি ৷ আরেকটি পুজো হত সর্বমঙ্গলা অয়েল মিলে ৷ প্রতিমাটি ছিল মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু ৷ সে এক ভয়াবহ ব্যাপার !
ক্রমে প্রতিটা পাড়াতেই বারোয়ারি পূজা শুরু হল ৷ এল প্রতিযোগিতা ৷ দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানষ তাঁদের সংস্কৃতিও নিয়ে এলেন সঙ্গে করে ৷ ঢাকিদের ঢাকবাদ্যের ভঙ্গি পালটে গেল ৷ এল ধুনুচি নৃত্য ৷ সেইসঙ্গে পল্লিগীতি ৷ প্রয়াত নির্মলেন্দুবাবুও কয়েকবার এখানে এসে অনুষ্ঠান করেছেন ৷ ক্রমশ ক্রমশ পুজোর ধরন পালটালেও ভক্তি ও পবিত্রতার অভাব ঘটেনি ৷ মা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই ছিলেন ৷ এখনকার মতো থিম পুজোর আড়ালে চলে যায়নি ! সেই পুজোতে মাটির গন্ধ মাখা শিশিরবিন্দুতে ভেজা অদ্ভুত একটা ভক্তির ভাব প্রকাশ পেত ৷ ধুনোর গন্ধ মাখা একটা শারদ সুবাস নাকে নয়, মনে এসে লাগত ৷ আমাদের মতো কিশোররা রাতের ঘুমে মাকে স্বপ্ন দেখত- মা তাঁর পরিবারের সকলকে নিয়ে সবুজ মাঠের কাশফুলের আড়ালে আড়ালে খেলা করছেন ৷ খিল খিল করে হাসছেন ৷ গঙ্গার কূলে নৌকাটি বাঁধা আছে ৷ দিনু মাঝির সেই বিখ্যাত নৌকা ৷ যেটি করে তিনি এসেছেন, আবার চলেও যাবেন ৷ আমি আর আমার বন্ধু অনাথ পুজোয় যে একজোড়া প্যান্ট-শার্ট হয়েছে, মা চলে যাওয়ার পর সেটি আর পরতুম না ৷ অনাথ বলত, খুলে রেখে দে ৷ মা চলে গেছেন, আর এসব পরে কী হবে ! আমার দিদি তখন বলত, এগুলো না পরলে পুরোনো হবে কী করে ? পরের বছর মা এলে তো আবার নতুন পরতে হবে ৷ অনাথ তখন বিজ্ঞের মতো বলত, কথাটা খুব ঠিক রে ৷ সূর্য যেমন পূব থেকে পশ্চিমে যায়, উদয় থেকে অস্ত ৷ চিরকালের জন্য তো চলে যায় না ! মা-ও সেইরকম ৷ নদীর এপার আর ওপার ৷ আশা আর যাওয়া ৷