পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / city

কেমন ছিল প্রাণের পুজো ? স্মৃতিসুধায় ডুব

পাবনার বাড়ির পুজোয় সব জাত ও জাতীয় মানুষ অংশগ্রহণ করত ৷ বিজয়ায় ঠাকুমার হাতের তৈরি বাঙালি ঘুঘনি আর হবে না, বললেন ওঁরা ৷ নিজেদের ফেলে আসা দুর্গাপুজোর স্মৃতিতে ডুব দিলেন পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি ও সাহিত্যিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ৷

By

Published : Oct 26, 2020, 8:43 PM IST

Updated : Oct 27, 2020, 9:07 AM IST

author-ranjan-bandyopadhyay-and-nrisingha-prasad-bhaduri
author-ranjan-bandyopadhyay-and-nrisingha-prasad-bhaduri

আজকের মতো থিম পুজোর ভিড় তখন একেবারে ছিল না । কেমন ভাবে কাটত তখনকার পুজো ? নিজেদের ফেলে আসা দিনের পুজোর স্মৃতি ETV ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি ও সাহিত্যিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ।

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি

পুজোর স্মৃতির মধ্যে একটা হল বিসর্জনের স্মৃতি ৷ সেটা কিন্তু আনন্দের সুর না, বিদায়ের সুর ৷ আমি তো পুরোটা এদেশের লোক না ৷ আগে পূর্ববঙ্গে ছিলাম ৷ আমাদের পাবনার বাড়িতে পুজো হত ৷ এক মাস আগে থেকে আনন্দ শুরু হত ৷ ছোটো-বড় প্রস্তুতি ছিল, তার জন্যই আনন্দ ৷ যেমন, ঠাকুর আমাদের বাড়িতেই তৈরি হত যে ৷ আমার একটা জিনিস কেবল মনে পড়ে, পুজোর দু'মাস আগে বর্ষা তখনও শেষ হয়নি, সেই সময় খুলনা-যশোর থেকে নৌকা বোঝাই করে নারকোল আসত ৷ আমার কাকারা হাঁটুজলে নেমে সেই নৌকো থেকে নারকোল নামাতেন নদীর ঘাটে ৷ তারপর তা বাড়িতে আসত ৷ এরপর সেই নারকোল বাছাই করতেন বাড়ির গিন্নিমারা ৷ বাছাই নারকোল বিজয়ায় কাজে লাগবে ৷ আমাদের মতো ছোটোদের মজাটা সেখান থেকেই শুরু হত ৷ আমরা বুঝতাম এবার পুজো আসছে ৷ এর পরের আনন্দ ঠাকুর বানানো নিয়ে ৷ আমি দেখতাম শিল্পীরা কেমন প্রথমে বাঁশের কাঠামো গড়তেন, তারপর খড়, তারপর মাটি ৷ তা থেকেই ঠাকুরের অবয়ব তৈরি হত ৷ এটা আমার কাছে খুবই আশ্চর্যের ছিল ৷ বীভৎস বাঁশের কাঠামো থেকেই অমন সুন্দর ঠাকুর ! এটা একটা দুর্লভ স্মৃতি !

আমাদের ছোটোবেলায় পুজোতে কতরকমের মানুষ থাকতেন । শুধু হিন্দুরাই পুজোর নানারকম কাজে অংশগ্রহণ করতেন তেমন নয় ৷ অন্যরাও থাকত ৷ এসব কথা নিয়ে তখন ভাবতাম না । কিন্তু এখন মনে হয় ।

কলকাতা থেকে ফেরার পথে আমার দাদারা শোলার সাজ নিয়ে আসতেন ৷ তারা দেরি করলে চিন্তা হত ৷ একটা টেনশন আর কী ৷ কবে আসবে, কবে আসবে ! গ্রামের সবাই নিমন্ত্রিত থাকতেন ৷ সবাই ৷ সব জাত ও জাতীয় মানুষ ৷ পৃথক করে ভাবিনি ৷ এখন বুঝি, রাজনীতিই মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করে ৷ আমার বাপ-ঠাকুর্দার সঙ্গে বিজয়ার কোলাকুলিও করতেন মুসলমান প্রতিবেশীরা ৷ এটা আমার কাছে একটা বড় স্মৃতি ৷ আগে বড় মনে হয়নি । এখন মনে হয় । কারণ এটা আর হতে দেখি না ৷

পরবর্তীকালে 7-8 বছর বয়সে এদেশে আসি ৷ কেওড়াতলার কাছে সাহানগরে থাকতাম ৷ সেখানেও পুজো খুবই উদ্দীপনার ছিল ৷ প্যান্ডেল তৈরির ব্যাপারটা খুব আকর্ষণীয় ছিল ৷ দেশে দেখিনি ৷ ওই প্যান্ডেলের বাঁশ বেয়ে উঠতাম আমরা ছোটোরা ৷ বাঁশ ভেঙেও যেত ৷ তবে কেউ কিছু বলত না ৷ পুজোর গানের একটা ব্যাপার ছিল ৷ অনেকের অনেক পুজোর গান বিখ্যাত হয়ে আছে ৷ মাইকে গান চলত ৷ সেটা কিন্তু অত্যাচারের পর্যায় ছিল ৷ এক গান সারাদিন ধরে কয়েকশো বার বাজানো হত ৷ সেই সময় চাঁদার উপর পুজো হত ৷ স্পনসর ছিল না ৷ চাঁদা নিয়ে ঝগড়া হত ৷ তখনকার মধ্যবিত্তের অল্প রোজগার ৷ গৃহস্থের অবস্থা বুঝতে চাইত না যারা চাঁদা কাটত তারা ৷ স্পনসর না থাকলে এখনও চলত এই সমস্যা ৷ সাহিত্যেও উঠে এসেছে চাঁদার সমস্যার কথা ৷ তখন ভোগ রান্না হত বাড়িতে বাড়িতে ৷ বিসর্জনের দিনেই বিসজর্ন হত ৷ আর একটা কথা, এমন সিঁদুর খেলা কোথাও দেখিনি আমাদের সময় ৷ আমার ধারণা, এইসব ব্যবসায়ীরাই চালু করেছে ৷ আমার কাছে যেটা খারাপ লাগে, সেটা হল সিঁদুর নিয়ে মাতামাতি ৷ আমার কাছে মেকি লাগে ৷ আগে মা-কে সিঁদুর দেওয়ার পর নোয়াতে সিঁদুর লাগানো হত, মাথায় ছোঁয়ানো হত ব্যস ৷

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

2020-র দশমীর মতো কোনোও দশমী জীবনে কাটাইনি । আমার মনে হয়, বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে কোলাকুলি বিহীন দশমী এর আগে কখনও আসেনি ৷ বঙ্গ দুর্গাপুজোর বয়স 500 বছরের বেশি ৷ পাঁচশো বছর ধরে দুর্গপুজোর অবয়ব এবং শৈলি পরিবর্তীত হয়েছে ৷ কিন্তু মাকে বিসর্জন দেওয়ার পর ভয়ে ভয়ে মেয়েরা সিঁদুর খেলছেন কিংবা পুরুষেরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছেন না, এমন বিজয়া বাঙালি দেখেনি ৷

আমার ছোটোবেলার বিজয়ার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে প্রথমেই মনে পড়ে, আমার ঠাকুমার হাতের তৈরি বাঙালি ঘুঘনি ৷ এই ঘুঘনি এখন আর বাঙালি বাড়িতে তৈরি করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে শহরের বাঙালি বাড়িতে ৷ কারণ, এই ঘুঘনি তৈরি হত একশো বছর আগের স্টাইলে ৷ সেই স্টাইল মাটির বা তোলা উনুন ছাড়া, গুল এবং গোবরের আঁচ ছাড়া সম্ভব না ৷ কারণ, সারারাত ধরে ওই মরা আঁচে সিদ্ধ করা হত ঘুঘনির মটর ৷ তাই অমন স্বাদ আসত ৷ সেই স্বাদ ঠাকুমাকে প্রণাম করার পর আমরা পেতাম ৷ আর পাই না ৷ তারপর যখন বড় হলাম কিন্তু খুব বড় নয়, তখন বিজয়ার দিন মা বাবার সঙ্গে সিদ্ধির সবুজ পায়েস খেতাম ৷ বিজয়া এলে আমার এখনও মনে পড়ে, আমার মায়ের নেশা ধরা মুখ ! এবং মন কেমন করে ! আরও যখন বড় হলাম তখন আমার ব্যক্তিগত বিজয়ার সঙ্গে মিশে আছে প্রেম ৷ দুর্গাপুজো শেষ হল বটে এবার এল ভিড় থেকে সরে গিয়ে প্রিয় মেয়েটির সঙ্গে একা হওয়ার এবং নেশা করার সুযোগ ৷ যেহেতু আমি একা আছি বহুকাল ৷ বিজয়ার দিন একাই অপেক্ষা করেছি বাড়িতে ৷ কখন আসবে আমার ভলোবাসার নারী ৷ তাঁরও প্রিয় পানীয় আমারই মতো স্কচ ৷ বিজয়ার দিন আর কোনও পানীয় ভালো লাগে না । ভালোবাসার মেয়ের সঙ্গে স্কচের গন্ধ মিশে আছে আমার বিজয়ার রাতের গায়ে ৷

বিজয়া বলতে আর যা মনে পড়ে, তা হল আর্জেন্তিনায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যখন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর দেখা হল তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিজয়া বলে ডাকলেন ৷ ওকাম্পো অবাক হয়ে বললেন, বিজয়া মানে কী ? রবীন্দ্রনাথ উত্তরে বললেন, বিজয়া, তুমি এসেছ আমার বিদায়ের কালে ৷ তাই তোমার নামের সঙ্গে জড়িয়ে দিলাম বিদায়ের অনুসঙ্গ ৷ প্রতি বিজয়ার দিন আমার রবীন্দ্রনাথের এই শেষ প্রেমের কথাও মনে পড়ে ৷

Last Updated : Oct 27, 2020, 9:07 AM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details