আজকের মতো থিম পুজোর ভিড় তখন একেবারে ছিল না । কেমন ভাবে কাটত তখনকার পুজো ? নিজেদের ছোটোবেলার পুজোর স্মৃতি ETV ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন সাহিত্যিক বাণী বসু ও প্রচেত গুপ্ত ।
পুজোর স্মৃতিসুধায় লেখিকা বাণী বসু
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় লেখিকা বাণী বসু পুজোর পৃথিবীটা যেন বদলে গেছে । এখন যা দেখি সবই নতুন লাগে । এত আড়ম্বর, পুজোর থিম, কর্পোরেট প্রতিযোগিতা - না, এসব তখন ছিল না । এখন মাঝে মাঝে মনে হয় পুজোটা আদৌ হয় তো ? নাকি সবকিছুই 'দেখনদারির খেলা' !
স্মৃতি সততই সুখের হয় না । তবে কিছু সুখস্মৃতি থেকে যায় জীবনভর । মনে পড়ে, নতুন বছরের ক্যালেন্ডার বাড়িতে এলেই চোখ চলে যেত আশ্বিন মাসের পাতায় । একবার দেখে নিতাম পুজো কবে । হয়ত বা তখন থেকেই শুরু হয়ে যেত দিন গোনা । রক্ষণশীল পরিবারে সেভাবে আবেগের বিস্ফোরণ সম্ভব ছিল না । তবে মনের কোণে কোথাও একটা পুজো নিয়ে আবেগ তো থাকতই ।
পুজো মানে নতুন জামা । পুজো মানে দিন কয়েকের সকাল-বিকেলের পড়াশোনায় ইতি । দিন কয়েকের বেহিসাবি জীবন ।
মনে আছে মহালয়ার ভোরে রেডিয়োতে শুনতাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী । ভক্তিভরে সেটা শুনতে শুনতেই বাইরের দিকে দেখতে পেতাম ধীরে ধীরে ফর্সা হচ্ছে পৃথিবী । একটু একটু করে আবির্ভাব হচ্ছে জবাকুসুমের ।
আমি উত্তর কলকাতার মেয়ে । তখন দক্ষিণ কলকাতায় তেমন পুজো ছিল না । থাকলেও আড়ম্বর একেবারেই ছিল না । কলকাতায় পুজো বলতে বোঝাতো উত্তর কলকাতাকে । বড় বড় ঠাকুর, বড় বড় প্যান্ডেল, মানুষের ভিড় সবই ছিল উত্তর কলকাতাকে কেন্দ্র করে । এখন আর তেমনটা নেই । উত্তর-দক্ষিণ, শহরতলি সর্বত্রই প্রচুর পুজো হচ্ছে । তার অনেকগুলি অবশ্যই বিগ বাজেটের ।
ঠাকুর দেখা আমার সেভাবে হত না । কারণ ওই একটাই... পরিবারের রক্ষণশীলতা । সেকালে শিক্ষিত রুচিশীল পরিবারে ওভাবে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার রেওয়াজ খুব কমই ছিল । তবে বাড়ির সবার সঙ্গে দু'চারটে ঠাকুর নিশ্চয়ই দেখতাম । সঙ্গে ছিল নিয়মের বাইরে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া । খুব মজা করে ফুচকা খেতাম, ঝালমুড়ি খেতাম । আর হাওয়া মিঠাইয়ের মতো একটা জিনিস পাওয়া যেত । সেটাকে প্রবল আগ্রহ ছিল । কারণ ওগুলি নানা ধরনের আদলে বানিয়ে দিত । খাবার থেকেও সেই আদলটার জন্য অত্যন্ত প্রিয় ছিল ব্যাপারটা ।
পরে কিছুটা বড় হয়ে বয়ঃসন্ধির সময়টায় পুজো সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয় । তখন অপেক্ষা করে থাকতাম পুজো সংখ্যাগুলির । ভালো উপন্যাস, গল্প তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম । সেই গল্পে যেভাবে পুজো প্রেমের কথা বলা হত, তা অবশ্য কোনওদিন তেমনভাবে হয়নি । ওই যে বললাম... সেকালে শিক্ষিত রুচিশীল পরিবারের মেয়েরা কেউ পুজোয় মাখোমাখো প্রেমে ভেসে যাওয়া বলতে কী বোঝায়, তা জানত না । তবে হ্যাঁ, কাউকে কাউকে দেখে মনের কোণে একটু মেঘ জমেছিল বৈকি । একবার ঢাকের তালে একটা ছেলেকে দেখে বেশ ভালো লেগে গেছিল । তবে সেটা দু'দিনের । ওই ইনফ্যাচুয়েশন আর কী ।
পুজোর স্মৃতিসুধায় সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত পুজোর স্মৃতি তো এক এক জনের কাছে এক এক রকম ভাবে আসে । খুব ছোটোবেলার স্মৃতি বলতে মনে পড়ে নতুন জামা, জুতো পরে পাড়ার মণ্ডপে বড়দের সঙ্গে ঘুরতে যেতাম । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্মৃতিগুলিও বদলায় । আজকের এই পরিস্থিতিতে যে বিষয়টা সবথেকে বেশি মনে পড়ছে, তা হল আমার কোনওদিন ঠিক ভিড়ের মধ্যে গিয়ে পুজো দেখার টান ছিল না ।
আমার কৈশোর কেটেছে কলকাতা থেকে একটু বাইরে, মফস্বলে । আজ থেকে প্রায় 42-44 বছর আগে । থিম পুজোর রমরমা তখনও হয়নি । তবে তখনও পাড়ায় পাড়ায় ভিড় হত । কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপে তখনও ভিড় হত । সেই সময় আমরা বন্ধুরা মিলে ঠিক করি, আমরা ওই ভিড়ের মধ্যে যাব না । আমরা অন্য কিছু করব । সকালবেলা চলে যেতাম গঙ্গার ঘাটে । শুনতে আশ্চর্য লাগে, কিন্তু তখন এমনই করতাম আমরা । বাসে করে চলে যেতাম । গঙ্গার ঘাটে গিয়ে আমরা বন্ধুরা মিলে অনেকক্ষণ গল্প করতাম । মাটির ভাঁড়ে চা খেতাম । গঙ্গার ঘাট তখন বেশ নির্জন থাকত । সেই নির্জনতা উপভোগ করতাম বন্ধুরা মিলে ।
আরও পড়ুন : বাড়িতে থেকেই মণ্ডপ দর্শন, নজর কেড়েছে যেসব পুজো
এরপর যখন আর একটু বড় হলাম, তখন যেতাম গ্রামের পুজো দেখতে । কলেজে পড়ি তখন । উত্তর 24 পরগনার বেড়াচাঁপা, ধান্যকুড়িয়ার দিকে চলে যেতাম । ওখানে আমার বন্ধুর দেশের বাড়ি আছে । দু-তিনটে পুজো হত । সকালে যেতাম, সন্ধেবেলা ফিরে আসতাম । পুজোর ভিড়ে না গিয়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটাতাম । এখনও চোখের সামনে ভাসে সেই দিনগুলি ।
আরও বড় হয়েছি । আরও স্মৃতি বদলেছে । তখন পুজো হলেই চলে যেতাম কলকাতা থেকে বাইরে । শান্তিনিকেতনে গিয়ে সময় কাটাতাম । পুজোয় আমার স্মৃতি বলতে মনে পড়ছে, সবসময় ভিড় থেকে বাইরে থাকার চেষ্টা করেছি । দূর থেকে উপভোগ করেছি । নির্জনে গিয়ে উপভোগ করেছি । আজ স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা হচ্ছে । আমার স্মৃতি কিন্তু সবসময়ই ফাঁকায় থাকার স্মৃতি ।