কলকাতা, 13 জানুয়ারি : ওঁর পুরো নাম কানওয়ার দীপ সিং? যদিও ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক মহলে উনি কে ডি সিং বলেই পরিচিত। আজকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি কেডি সিংকে গ্রেপ্তার করেছে অর্থপাচারের অভিযোগে। অভিযোগ যে সিংয়ের সংস্থা অ্যালকেমিস্ট ইনফ্রা রিয়ালিটি লিমিটেড নিয়ম বহির্ভূত ভাবে বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে 1,900 কোটি টাকা সংগ্রহে করেছে এবং পরে সেই টাকা বেআইনিভাবে বিদেশে পাচার করেছে।
2016 সালে সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া বা সেবি সিং দ্বারা পরিচালিত অ্যালকেমিস্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে এবং সেই মামলার ভিত্তিতে সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে ইডি। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় যে 2019-এর জানুয়ারি মাসে ইডি ওই একই ক্ষেত্রে সিং দ্বারা পরিচালিত এই সংস্থাটির 239.29 কোটি টাকার সম্পদ সংযুক্ত করেছিল। সংযুক্ত সম্পত্তির মধ্যে ছিল দুটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের জমা টাকা এবং চণ্ডীগড়, পাঁচকুলা, দেড়বাসী, এসএএস নগর (পঞ্জাব) এবং সিমলাতে অবস্থিত বেশ কিছু স্থাবর সম্পত্তি।
ইডির অভিযোগ যে বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্পর গল্প দিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করা হলেও, সেই টাকা তহবিল বর্ণিত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়নি এবং অন্যান্য গ্রুপ সত্তার অ্যাকাউন্টগুলিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল, যার সংস্থাগুলো ছিল শুধুমাত্র খাতায়কলমে।
আরও পড়ুন :গ্রেপ্তার কে ডি সিং
গ্রেপ্তার হওয়া এই কে ডি সিং কিন্তু এককালে দাপটের সঙ্গে ছড়ি ঘুরিয়েছেন ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক মহলে। তিনি 1988 সালে টিউব্রো ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যানারে ব্যবসা শুরু করেন। 2004 সালে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে অ্যালকেমিস্ট করা হয়। কে ডি সিং একসঙ্গে অনন্ত মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের প্রধান শেয়ারহোল্ডার। অনন্ত মিডিয়া ভারতের শীর্ষস্থানীয় অনুসন্ধানী সাপ্তাহিকদের মধ্যে অন্যতম তহেলকা ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। 2013 সালে, তহেলকা জানিয়েছিলেন যে উত্তর হরিয়ানা রাজ্যের পঞ্জাবিরা সিংকে তাদের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে চান।
কে ডি সিংয়ের শিক্ষা জীবনও যথেষ্টই উজ্জ্বল। কেমব্রিজ (ইউকে) অ্যাঞ্জলিয়া রুসকিন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ব্যবসায় প্রশাসনে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
তার রাজনৈতিক জীবনেও যথেষ্ট মশলার উপাদান রয়েছে। 2010 সালে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) তাঁকে রাজ্যসভায় মনোনীত করে। এর মাত্র কয়েক মাস পরেই তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য হয়ে দলবদল করেন। যেহেতু সেই সময় তিনি রাজ্যসভাতে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার একমাত্র সদস্য ছিলেন তাই দলত্যাগ বিরোধী আইনে তাঁর উপর লাগু হয় না এবং তিনি রাজ্যসভার সদস্য থেকে যান।
2014 সালের এপ্রিলে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন ৷ এর কিছুদিন পরেই তৃণমূল কংগ্রেস পার্টিতে তাঁর কদর বাড়ে এবং তিনি পার্টির সমগ্র উত্তর ভারতের প্রধান হিসাবে মনোনীত হন। গত বছর এপ্রিলে তার রাজ্যসভার মেয়াদ মেয়াদ শেষ হয়।
আরও পড়ুন :নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন, পুলিশি নিরাপত্তার দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ শুভেন্দু
বিরোধীদের দাবি যে তিনি এইসময় হয়ে ওঠেন তৃণমূল কংগ্রেসের অর্থ সরবরাহের প্রধান উৎস এবং সেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনিও তাঁর বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং অর্থ পাচারের ব্যবসা বাড়াতে থাকেন৷ বিরোধীদের আরও দাবি যে সেই সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ওঠে তাঁর ব্যবসায়ের এক প্রধান কেন্দ্র।
এর মধ্যে সিংয়ের বিরুদ্ধে রাজ্যসভায় অনৈতিকভাবে এবং অর্থের বিনিময় প্রবেশের অভিযোগ ওঠে। একটি বেসরকারি ওয়েবসাইটের করা একটি স্টিং অপারেশন দাবি করে যে রাজ্যসভা নির্বাচনের সময় ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছয় বিধায়ককে কোনও নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য অর্থের অফার দেওয়া হয়। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার বিধায়ক টেকলাল মাহাতো সেই স্টিং অপারেশনে দাবি করে যে রাজ্যসভার নির্বাচনে জেতার জন্য কে ডি সিং প্রচুর খরচ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) তদন্তভার গ্রহণ করে এবং সিংয়ের বিরুদ্ধে একটি এফআইআরও দায়ের করে।
আরও পড়ুন :'বাংলার মানুষ ওয়াইসির কথা শুনে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট দেবে না'
এরপরে 2009 সালের ফেব্রুয়ারিতে, আয়কর বিভাগ ভারতজুড়ে অ্যালকেমিস্ট গ্রুপের 11 টি অফিসে হানা দেন এবং মোট 22 কোটির মতো হিসাববিহীন অর্থের সন্ধান পায়। এরপর আবার 2013 সালে একাধিক মহল থেকে অ্যালকেমিস্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে ডিফল্টের অভিযোগ আসতে শুরু করে। তদন্ত সংস্থগুলোর নজর ভারতে অ্যালকেমিস্ট গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত পঞ্জি ব্যবসায়ের উপর। এরপরই এরপরে, সিকিওরিটিস আপিল ট্রাইব্যুনাল অ্যালকেমিস্ট ইনফ্রা রিয়েলটি লিমিটেডকে 18 মাস সময় সেবির আদেশ পালন করার জন্য। সেবির আদেশ ছিল যে অ্যালকেমিস্ট ইনফ্রা রিয়েলটি লিমিটেড যেন অবিলম্বে অননুমোদিত 'যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পের' মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা আনুমানিক এক হাজার কোটি টাকা যেন আবার বিনিয়োগকারীদের ফেরত দেয়। সেবির অনুমান অনুসারে সংস্থাটি প্রায় দেড় মিলিয়ন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল।
তখন থেকেই কে ডি সিংকে নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সরব হয় বিরোধী দলগুলি। এরপরই তৃণমূল কংগ্রেস আস্তে আস্তে দূরত্ব সৃষ্টি করতে তাঁকে কে ডি সিংয়ের সঙ্গে। এর পরে 2016 সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে প্রকাশ্যে আসে নারদ স্টিং অপারেশন যেখানে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময় তাঁকে নিতে দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেসের বহু নেতা এবং মন্ত্রীকে। সেই সময় এই খবর রটে যায় যে কেডি সিংই নারদ স্টিং অপারেশনের জন্য ম্যাথিউ স্যামুয়েলকে প্রায় 80 লক্ষ টাকা দেন।
আরও পড়ুন :মমতাকে সমর্থন করতে বাম-কংগ্রেসকে আহ্বান সৌগতর
এদিকে কেডি সিংয়ের গ্রেপ্তারির পরই তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে তীব্র বিতন্ডা শুরু হয়ে গিয়েছে। "কে এই কেডি সিং? তার পরিচয় হ'ল তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন রাজ্যসভার সদস্য৷ কে ডি সিংয়ের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের জেরা করা উচিত। তাহলেই প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে,"বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভার সদস্য সৌগত রায় বলেন যে যেহেতু তৃণমূল কংগেসের সঙ্গে কে ডি সিংয়ের দীর্ঘদীন কোনও সম্পর্ক নেই তাই এই সমস্ত দাবি অবাস্তব।