“বাংলা ভাষা আমাদের অনির্বাণ অগ্নি; ওই শিখা থেকে আগুন সংগ্রহ করতে হয় আমাদের সব সময়। এ-দেশের সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে জড়িত থাকে বাংলা ভাষা ও ২১; ওই চিরঞ্জীব মশাল থেকে আগুন নিয়েই জ্বালিয়ে দিতে হয় প্রতিক্রিয়াশীলতার সমস্ত দুর্গ।”
(হুমায়ুন আজাদ। বাঙলা ভাষার শক্রমিত্র। পরিশিষ্ট : দুই । ভাষা আন্দোলন ১৯৮২। পৃ-৬৯)
বাংলা ভাষার অন্যতম কৃতী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদের এই উক্তিতে 21 ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির গর্ব ও গৌরবের দিন কেন, 21 ফেব্রুয়ারির মর্মার্থ কী, কাকে বলে 21-এর চেতনা তার সবিস্তার উল্লেখ রয়েছে । উপযুক্ত সামান্য কয়েকটি বাক্যে বিন্দুতে সিন্দুর প্রতিফলনের মতো এই অসামান্য শক্তিশালী লেখক, ভাবুক, অধ্যাপক, ড. আজাদ একুশের পরিচয়কে তুলে ধরেছেন ।
বাংলা ও বাঙালির আবহমান হাজার বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে 1952 সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও শহিদের আত্মাহুতি এক অনন্য ঘটনা । আর সেই অনন্য আন্দোলনের ধারাবাহিক পরিণতি পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় । বাঙালি জাতির গৌরবময় উত্থান ।
2,
“যার মনের মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা সে বন্যপশু তুল্য'। -শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ অসাম্প্রদায়িক । ধর্মের যে বিষ পান করিয়ে উপ-মহাদেশকে বিভক্ত করা হয়েছিল সে বিষাক্ত চেতনাকে ব্যর্থ করে দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে 30 লাখ শহিদের রক্তে স্নাত এই দেশের জন্ম । উপ-মহাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে কবর দিয়ে এ-দেশের অভ্য়ুদয় । সাম্প্রদায়িকতা মূলত পশুত্বেরই নামান্তর । যে কথা তীব্র ঘৃণায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বাঙালির অবিসংবাদী নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । শুধু ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতাই নয়, বাংলাদেশে তার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোও বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ । বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের অনন্য উদাহরণ । মণিপুরী, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, লুসাই, খুমি, বম, খিয়াং, চাক, পাংখোয়া, তঞ্চঙ্গ্য়া, খাসিয়া, গারো, পান, রাখাইন-সহ মোট 45টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাস এদেশে । সরকার সমস্ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণে, এদের বিকাশে, এদের জীবন জীবিকার মানোনয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে । তারা যাতে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তার জন্য বইপত্র প্রকাশ-সহ সমস্ত সহযোগিতা প্রদান করছে । এদেশের জনসংখ্যার 1.10 ভাগ অর্থাৎ প্রায় 16 লাখের বেশি মানুষ এই 45টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য। তারা তাদের স্ব-ধর্ম সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ অধিকার নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে অবস্থান করছে বাংলাদেশে । কারণ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ আর শুধুমাত্র বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী কিংবা একটি-দুটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর দেশ নয় । এদেশ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সর্বপ্রাণবাদী, আদিবাসী সব ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্মভূমি ।
আরও পড়ুন: 21-এর 21: নজরে থিম, ফিরে দেখা ইতিহাস
3,
বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য- বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম উপাদান । এই ঐক্য অন্তরের, এই ঐক্য সংস্কৃতির সেতু রচনার । যে কোনও রকম সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা এই ঐক্যের প্রতিবন্ধক । ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কিংবা আর্থিক সংকীর্ণ চেতনা- যা অন্যের অধিকারকে সমান মর্যাদা দেয় না, অস্বীকার করে, তা বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার শত্রু । সব ধর্মের মিলিত সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতি । বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ । এখানে সব ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীন । ধর্ম আমাদের মানবতা ও উদারতার শিক্ষা দেয় ।” বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সরস্বতী পুজো উপলক্ষে 16 ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তৃততর রূপটিকে এভাবেই ব্যক্ত করেছেন । তিনি আরও বলেন, "আমরা বিশ্বাস করি, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার ।"
- কাকে বলে একুশের চেতনা ? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ?
পৃথিবীব্যাপী সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার যে স্পৃহা, যে অনুপ্রেরণা- তাকেই ধারণ করি আমরা আমাদের একুশের চেতনায় । তাকেই লালন করি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ।
4,
“বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে