দুর্গাপুর, 21 আগস্ট: 2002 সাল । দুর্গাপুরের রাষ্ট্রায়ত্ত MAMC (মাইনিং অ্যান্ড অ্যালাইড মেশিনারি কর্পোরেশন) পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে যায় । 2010 সাল এই কারখানা অধিগ্রহণ করতে আগ্রহী হয় DVC, কোল ইন্ডিয়া ও ভারত আর্থ মুভার লিমিটেড । হাইকোর্ট থেকে 100 কোটি টাকার বিনিময়ে এই কারখানা যৌথভাবে অধিগ্রহণ করে DVC, কোল ইন্ডিয়া ও ভারত আর্থ মুভার লিমিটেড । কিন্তু এরপর কেটে গেছে 10 বছর । আজও খোলেনি কারখানা । আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এই কারখানা খোলার দাবিতে সরব হয়েছেন দুর্গাপুরবাসী ।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেশে ভারী ও বুনিয়াদি শিল্প গড়ার উপর জোর দেওয়া হয় । 1956 সালে দেশীয় শিল্পনীতি তৈরি হয় । এই শিল্পনীতি তৈরি করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত স্নেহধন্য প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন । তৎকালীন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক ইনস্টিটিউশনের দায়িত্বে থাকা প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ সারাদেশে চারটি ভারী শিল্প তৈরি পরিকল্পনার কথা বলেন । তার মধ্যে তিনটি তৈরি হয়েছিল তৎকালীন বিহারের রাঁচিতে এবং একটি দুর্গাপুরে । সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন নামের এই কারখানা । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরে সোভিয়েত রাশিয়া ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করে । তাই রাঁচিতে যে তিনটি কারখানা হয়েছিল তার মধ্যে দুটি সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এবং একটি চেকোস্লোভাকিয়া সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে । আর দুর্গাপুরে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন ।
প্রথমদিকে এই কারখানা মূলত কোল মাইনিং মেশিনারি তৈরি করার জন্যই প্রতিষ্ঠা হয় । 1959 সালে রাশিয়াতে প্রশিক্ষণ নিতে যায় বহু ইঞ্জিনিয়র । দুর্গাপুরের গোপীনাথপুর মৌজা বর্তমানে দুই নম্বর জাতীয় সড়কের একেবারে গা ঘেঁষে এই কারখানা তৈরি হয় । মোট 195 একর জমিতে এই কারখানা তৈরি হয় । তৎকালীন সময়ের নিয়ম অনুযায়ী ভারী শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে টাউনশিপ গড়ে তোলার কথা এবং সেই মতো প্রায় 495 একর জায়গায় গড়ে উঠেছিল বিশ্বকর্মা নগরী । প্রায় 4 হাজার আবাসন তৈরি হয় সেখানে । পরবর্তী ক্ষেত্রে দেখা যায় যে শুধুমাত্র কয়লা খনির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি তৈরি করে এই কারখানাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না । তখন এই কারখানার নামকরণ বদলের পাশাপাশি, এই কারখানাকে কোর ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করা হয় । নামকরণ হয় MAMC ।
1964 সালে জওহরলাল নেহরু এই কারখানা উদ্বোধন করেন । ঠিক তার পরের বছর 1965 সালে কারখানা পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী । এই কারখানা থেকেই খনি কাজে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে লৌহ ও ইস্পাত কারখানাগুলিতে কোল হ্যান্ডেলিং প্লান্ট, বহু পাওয়ার প্লান্ট ছাড়াও হলদিয়া বন্দর, ওড়িশার বিভিন্ন বন্দরের বহু যন্ত্রাংশ এই কারখানা থেকেই তৈরি হত ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতের অন্যতম সফল এই MAMC কারখানায় প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ হয়েছিল । এক সময় এই কারখানার স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল 7300 জন । এবং অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় 300 । রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানায় উৎপাদন ঠিক থাকলেও শ্রমিকদের মাইনে বাবদ বিশাল অঙ্কের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে এক সময় এই কারখানা ক্ষতির মুখে চলে যায় । 1990 সালে এই কারখানাকে রুগ্ন শিল্প বলে ঘোষণা করা হয় । সেই সময় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আদালতের দ্বারস্থ হয় । কিন্তু কারখানাকে বাঁচানো যায়নি । 2002 সালের জানুয়ারি মাসে পাকাপাকিভাবে এই রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানায় তালা পড়ে যায় । শুরু হয় আইনি লড়াই । তখন এই কারখানার শ্রমিক সংখ্যা মাত্র আড়াই হাজার ছিল ।