বর্ধমান, 28 সেপ্টেম্বর : বর্ধমানের মহারাজ তখন মহাতাব চাঁদ । রাজবাড়ির কুলদেবী দেবী চণ্ডিকা । শোনা যায়, রাজার ইচ্ছে হয়েছিল রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো করার । সে কথা কুলপুরোহিতকে জানানো হলে তিনি নিদান দেন মূর্তি পুজো করা যাবে না । পটে এঁকে পুজো করা যেতে পারে । সেই থেকেই শুরু হয়েছিল পটেশ্বরী দুর্গার পুজো ৷
বর্ধমান স্টেশন থেকে দক্ষিণ দিক বরাবর জিটি রোড ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার গেলেই মিলবে কার্জন গেট । কার্জন গেটের ভিতর দিয়ে পশ্চিম দিক বরাবর সোজা প্রায় তিন কিলোমিটার গেলেই মিলবে সোনাপট্টি । সেই সোনাপট্টির পাশেই আছে রাজকাছারি বাড়ি । বাড়ির মাথায় রয়েছে টাওয়ার ক্লক । ঠিক তার পাশেই আছে শ্রীশ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দির । এই মন্দিরে প্রবেশ করলেই প্রথমে মিলবে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাসমঞ্চ । তারপর মিলবে বিশাল নাটমঞ্চ । আর ভিতরে রয়েছে পটেশ্বরী দুর্গা । এখানে দেবী দুর্গার বিসর্জন হয় না । প্রতি বারো বছর অন্তর দেবীর অঙ্গরাগ করা হয় । সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে হয়ে আসছে এই পটেশ্বরী দুর্গাপুজো ।
সেই রাজবাড়ির ঐতিহ্য আজ আর নেই । শ্রীশ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে প্রবেশ করলে আজও দেখা মিলবে কারুকার্যখচিত রাসমঞ্চের । আজ আর পুজোর সময় ঝাড়বাতি জ্বলে না । তবে রাজবাড়ির ঐতিহ্য মেনে আজও পুজো করা হয় ।
প্রতিপদ থেকে ন'দিন ধরে পুজো চলে । আগে দেবীকে বাহান্ন রকমের ভোগ নিবেদন করা হত । দেওয়া হত সুপুরি বলি । এখন আর বলিদান প্রথা নেই । এখন দেবীকে লুচি ভোগ নিবেদন করা হয় । সেই সঙ্গে চলে গুজরাতি সম্প্রদায়ের ডান্ডিয়া নৃত্য ।
বর্ধমানের রাজপরিবারের পটেশ্বরী দুর্গার পুজোয় ন'দিন ধরে চলে গুজরাটি সম্প্রদায়ের ডান্ডিয়া নৃত্য লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উত্তম মিশ্র বলেন, "রাজবাড়ির পটেশ্বরী দুর্গাপুজো প্রায় তিনশো সাড়ে তিনশো বছরের পুরানো । মহাতাব চাঁদ এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন । প্রথমে বর্ধমানের রাজবাড়ি অর্থাৎ বর্তমানে যেটা বর্ধমান মহিলা কলেজ সেখানে ছিল রাজবাড়ির দুর্গামন্দির । সেই মন্দিরে পটেশ্বরী দুর্গার পুজো করা হত । পরবর্তীকালে সেই মন্দির ভেঙে যাওয়ায় দেবীকে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে এনে পুজো করা হয় । এখানে প্রতিপদের দিন ঘট স্থাপন করা হয় । দশদিন ধরে পুজো চলে । আগে দেবীকে বাহান্ন রকমের ভোগ নিবেদন করা হতো । এখন অষ্টমী এবং নবমীতে দেবীকে লুচি-হালুয়া ভোগ নিবেদন করা হয় । রাজার আমলে দেবীকে কৃষ্ণসায়রে বিসর্জন করা হত এবং বিসর্জন করার পরই ঢাকা দিয়ে দেবীকে তুলে নিয়ে আসা হত । কিন্তু এখন বিসর্জন প্রথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে । তার পরিবর্তে 12 বছর অন্তর দেবীর অঙ্গরাগ করা হয় ।"
রাজবাড়ির দেওয়ান পরাণচাঁদ কাপুরের অষ্টম পুরুষ বিষাণচাঁদ কাপুর বলেন, "মহারাজ মহাতাব চাঁদের আমলে পটেশ্বরী দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল । রাজবাড়ির মন্দির নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পটেশ্বরী দুর্গাকে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে স্থানান্তর করা হয়েছিল । আমাদের ক্ষত্রিয় সমাজে দেবী দুর্গাকে ভোগ হিসাবে লুচি-হালুয়া নিবেদন করা হয় । সেই রীতি মেনেই এখনও দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হচ্ছে । রাজবাড়িতে মহিলাদের ঠাকুর দর্শনের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল । তখন জাঁকজমক করে পুজো করা হত । কিন্তু কালের স্রোতে সব শেষ হয়ে গিয়েছে । তবে এখনও নিয়ম-নিষ্ঠাভরে পুজো করা হয় ।"
আরও পড়ুন : Durga Pujo : 300 বছর ধরে মেদিনীপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারে অসুর ছাড়া পূজিত হন অভয়া দুর্গা