আসানসোল, 27 অগস্ট: আসানসোলের সিটি বাস স্ট্যান্ড, হটন রোড চারমাথা মোড়ের পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত প্রায় দুশো বছরের পুরনো ভবনটা ৷ খনি, শিল্পাঞ্চলের মানুষের কাছে নস্টালজিয়া, আসানসোল বাজার এলাকার ল্যান্ডমার্ক, শহরের বুকে একমাত্র আর্মেনিয় স্থাপত্য সেই ‘অটওয়াল ভবন’ (Asansol Atwal Bhavan) আর নেই ৷ মূলত বিপণন সংস্থার গ্রাসে হারিয়েই গিয়েছে আসানসোলের ঐতিহাসিক এই স্থাপত্য ৷
আসানসোল হটন রোড মোড়ে বাজারের শুরুতেই লাল ইঁটের প্রাচীন বিল্ডিং ৷ যার নাম অটওয়াল পরিবারের নামেই ‘অটওয়াল ভবন’ (Historic Atwal Bhavan The Armenian Architecture) ৷ হোটেল, পানশালা নানান নামে পরিচয় ছিল এই বিশাল বিল্ডিংয়ের ৷ এর ইতিহাস প্রায় 140 বছরের পুরনো ৷ যখন থেকে ব্রিটিশ, ইউরোপীয় মানুষদের আনাগোনা, বসবাস আসানসোলে, তখন থেকেই ৷ আসানসোলে কয়লা খননের পরেই রেলপথের সূচনা হয় ৷
শপিং মলের গ্রাসে ঐতিহাসিক অটওয়াল ভবন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলের প্রশাসনিক ভবন গড়ে উঠেছিল আসানসোলে ৷ প্রচুর ইউরোপীয়, ব্রিটিশ, খ্রিষ্টান মিশনারী নাগরিক রেলে চাকরির সূত্রে বা কয়লা খনিতে চাকরি করতে এই শহরে আসে। পাশাপাশি ব্যবসায়িক সূত্রে আপকার, আগাবেগ, গ্রেগারি, সহ আরও কয়েকটি আর্মেনিয় পরিবার আসানসোল শহরে ব্যবসা শুরু করেছিল ৷ আজও আসানসোল তাঁদের স্মৃতি বইছে বৈকি ৷ আসানসোলের আপকার গার্ডেন কিংবা আগাবেগ স্কুল সেই আর্মেনিয় ইতিহাস বুকে নিয়ে রয়েছে ৷ তবে, আর্মেনিয় স্থাপত্য বলতে ছিল এই ভবন ৷ যার পরবর্তীকালে নাম হয় অটওয়াল ভবন ৷ 1885 সালে আসানসোল শহরে নগর সভ্যতার রঙ লাগে ৷ তখনই আসানসোলের হটন রোড মোড়ে তৈরি হয় শহরের প্রথম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ৷ যা আর্মেনিয় ভবন বা ম্যাডাথ ব্রাদার্স নামে পরিচিত ছিল ৷ প্রথমে ছিল একতলা । পরে 1916 সালে দোতলা করা হয় এই ভবন ৷ অসাধারণ শিল্প শৈলী ও স্থাপত্যের নিদর্শন ছিল এটি ৷
আসানসোলের বিশিষ্ট গবেষক ও তথ্য সংগ্রাহক দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘‘রানিগঞ্জে ব্রিটিশ কারখানা বার্ন এন্ড কোম্পানির উৎপাদিত ইট দিয়ে ভবনটি তৈরি হয়েছিল ৷ ভবনটি ইউরোপীয় ও ভারতীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণ ইন্দো-সারাসেনিক বা ইন্দো-গথিক ধাঁচে নির্মীত ৷’’
আরও পড়ুন:চলচ্চিত্রে প্রথম অভিজ্ঞতাতেই সৌমিত্র-নাসিরুদ্দিনকে ছুঁয়ে ফেললেন আসানসোলের উৎসব
1947 সালে স্বাধীনতার সমসাময়িক কালে আসানসোলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী গুরবচন সিং অটওয়াল ভবনটি আর্মেনিয়ান ব্যক্তি ইউ ম্যাডাথের কাছ থেকে কিনে নেন ৷ এর পর সেখানে হোটেল তৈরি হয় ৷ অবিভক্ত বর্ধমান জেলা ও তৎকালীন বিহার প্রদেশের মানুষের কাছে এই হোটেল খুব অভিজাত ছিল ৷ বড় ব্যবসায়ী, রেল ও খনি, শিল্পাঞ্চলে আসা আধিকারিক, সেলিব্রিটিদের প্রথম পছন্দ ছিল এই হোটেল ৷ শোনা যায় উত্তমকুমারও এই হোটেলে রাত্রিযাপন করেছিলেন ৷ 1981 সালে নানান কারণে হোটেলটি বন্ধ হয়ে যায় ৷ তবুও, নীচের তলায় একটি পানশালা ও লাগোয়া পানীয়ের দোকান ছিল ৷ 2018 সালে সেই দোকান দুটিও বন্ধ হয়ে যায় ৷
জীর্ণ অবস্থায়, প্রায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকত ৷ তবুও আসানসোলের একসময়ের ইতিহাস এটি ৷ কিন্তু সেই চিহ্নটুকুও চলে গেল ৷ শতাব্দী-প্রাচীন আর্মেনিয় পরিবার নির্মিত সৌন্দর্যমণ্ডিত এই ভবনটি আর দেখা যাবে না ৷ ভবন ঢেকে গেছে বড় বিপনন সংস্থার বোর্ডে ৷ বর্তমানে সেই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি শপিং মলে পরিণত হয়েছে ৷ দূর্বাদল বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত মালিকানার কোনও ভবন মালিক বিক্রি করে দিতেই পারেন ৷ কিংবা, ভাড়া দিতে পারেন ৷ কিন্তু পুরনো রূপ অক্ষত রেখেই শপিংমল করা যেত ৷ ইতিহাস মুছে দেওয়ার এই ঘটনা মেনে নিতে পারছি না ৷ পৌরনিগম উদ্যোগী হোক আর্মেনিয় ভবনের সেই পুরনো রূপ ফিরিয়ে দিতে ৷’’ এমন ঘটনায় আসানসোলের মানুষও অসন্তুষ্ট ৷ মোহন ধীবর নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘কর্পোরেটের গ্রাসে গোটা ভারতবর্ষেরই ঐতিহ্য শেষ হয়ে যেতে বসেছে ৷ এটা তারই একটা নিদর্শন ৷’’