কলকাতা, 24 এপ্রিল : কয়েকদিন আগেই সোশাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়। ছবিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাবা আর মেয়ে। দু'জনের মুখেই হাসি। যদিও ছবিতে দেখা যায় দু'জনের পেটেই বড়সড় অস্ত্রোপচারের না মেলানো দাগ। ছবিটা আসলে ছিল এক গর্বিত বাবার গর্বিত মেয়ের ছবি। সত্যিই গর্বের। কারণ, তাঁরা দু'জনেই যা করেছেন অনেকেই তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না। ১৯ বছরের রাখি দত্ত তাঁর লিভারের ৬৫ শতাংশ দান করেছেন বাবাকে। কারণ তাঁর বাবার লিভার নষ্ট হয়ে যায়। একমাত্র উপায় ছিল লিভার প্রতিস্থাপন। কিন্তু উপযুক্ত ডোনার পাওয়া যায়নি। হাল না ছেড়ে তাই বাবাকে নিজের লিভারের ৬৫ শতাংশ দান করেন রাখি দত্ত। আর রাখির এই কীর্তিকেই এখন কুর্নিশ জানাচ্ছে নেটিজেনরা। তবে সেসবে পাত্তা দিতে নারাজ রাখি। ETV ভারতকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তাই জানালেন, বাবার কাছে ১৯ বছর ধরে যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন। তাই এটুকু বাবার জন্য তিনি করতেই পারেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আমাদের প্রতিনিধিকে রাখি বলেন, লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি। অপারেশনের ধকল তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে একমুখ হাসিতে বললেন, "ভীষণ ভালো আছি।" জানালেন, অপারেশনের ধকল কাটিয়ে তিনি শারীরিকভাবে এখন ঠিক আছেন।
ETV ভারত : কেমন আছেন এখন ?
রাখি : আমি এখন খুবই ভালো আছি ।
ETV ভারত : আপনার অপারেশন কবে হয়েছিল ?
রাখি : ২৭ ফেব্রুয়ারি ।
ETV ভারত : সোশাল মিডিয়ায় আমরা অনেক কিছুই দেখেছি । কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল ?
রাখি : আমার বাবা স্বাভাবিকই ছিলেন । হঠাৎ তার জন্ডিস ধরা পড়ল । বাবার বিলিরুবিন ১ সপ্তাহের মধ্যে ১৮ থেকে বেড়ে ৪৭ হয়ে যায় । প্রথমে আমরা কলকাতার একটি হাসপাতালে বাবাকে ভরতি করি । ২০ দিন হাসপাতালে ভরতি ছিলেন । এরপর ডাক্তার আমাদের জানান, বাবার লিভার নষ্ট হয়ে গেছে । সিরোসিস অফ লিভার হয়েছিল । আর কিছু করা যাবে না । এরপর আমরা বাবাকে হায়দরাবাদে নিয়ে যাই । সেখানে এশিয়ান ইন্সটিটিউট অফ গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিতে তাঁকে ভরতি করা হয় । স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ডাক্তার জানান, বাবার লিভারের ৯০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে । লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনও উপায় নেই । আমরা তখনও লিভার প্রতিস্থাপন বিষয়ে কিছুই জানতাম না । ডাক্তার আমাদের জানান যে, পরিবারের কাউকে লিভার দিতে হবে। প্রথমে ঠিক ছিল আমার মা লিভার দেবেন । কিন্তু মায়ের অতিরিক্ত ওজন এবং নার্ভের সমস্যার জন্য তা সম্ভব নয় । আমরা দুই বোন । দিদির লিভারের কাঠামো অন্য রকম তাই তাঁর থেকেও লিভার নেওয়া যায়নি । তারপরে সিন্ধান্ত নেওয়া হয় যে আমি বাবাকে লিভার দেব । প্রথমে বাবা রাজি হয়নি । কারণ আমি বয়সে ছোট । ডাক্তাররাও প্রথমে আমার বয়সের জন্য রাজি হচ্ছিলেন না । এরপর আমার ১০৯ রকম মেডিকেল টেস্ট হয় । রিপোর্টে আমার লিভারে একটি সমস্যা ধরা পড়ে । ডাক্তাররা জানান, আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি ঝুঁকির হবে । কিন্তু যেহেতু দিদি বা মা কেউই এই অপারেশনের জন্য তৈরি ছিল না তাই সিদ্ধান্ত হল যে আমি বাবাকে লিভার দেব । বলা হল আমার ৬৫ শতাংশ লিভার নেওয়া হবে । এরপর আমাদের অপারেশন হল ।
এরই মধ্যে বাবার অনেকরকম সমস্য দেখা দিচ্ছিল । মানসিক সমস্যাও দেখা দিয়েছিল । অপারেশনের ১ সপ্তাহের মধ্যে বাবার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে শুরু করে । এখন অনেক ভালো আছেন ।
ETV ভারত : যে মেয়েটি ইনজেকশনকেও ভয় পায় সে এত বড় একটা কাজ করল। কী বলবেন ?
রাখি : আমি এর আগে আমার রক্তের গ্রুপ জানতাম না । কোনওদিন আমি রক্ত দিইনি । সাধারণ জ্বর ছাড়া কখনও ডাক্তার দেখাতে হয়নি । এই প্রথম আমি ১০৯ টি টেস্ট করাই । প্রথমে আমার ১৬ বার রক্তের নমুনা নেওয়া হয়েছিল । ৩ দিনের মধ্যেই এই পরীক্ষাগুলো হয়েছিল ।
ETV ভারত : এখনও কি ইনজেকশনে ভয় পান ?
রাখি : তখন রক্ত নেওয়ার সময় ভয় পাইনি । কারণ বাবাকে সুস্থ করতে বদ্ধপরিকর ছিলাম । স্ক্যান, MRI ইত্যাদি অনেক পরীক্ষাই হয়েছে । ভয় পাইনি । তবে এখন রক্ত নিতে এলে দেব না ।
ETV ভারত : অপারেশনটা কত ঘণ্টার ছিল ?
রাখি : ১৫ ঘণ্টা ।
ETV ভারত : অপারেশনের আগে আপনার মাথায় কী চলছিল ?
রাখি : অপারেশনের আগের দিন একটা বোর্ড মিটিং হয়েছিল । এই মিটিংয়ে ১৬ জন ডাক্তার ছিলেন । তাঁরা জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট যে সবসময় ঠিক হবে এমন কোনও মানে নেই । অপারেশন টেবিলে আমার মৃত্যুও হতে পারে । এই অপারেশনটা ৯৫ শতাংশ সুরক্ষিত । কিন্তু ৫ শতাংশ ঝুঁকি থেকেই যায় । যেমন অনেকের হৃদস্পন্দন ধীরে চলতে থাকে । এই বিষয়গুলো আমাকে বলা হয়েছিল । কিন্তু আমি বাবার জন্য ৫ শতাংশ ঝুঁকি নিতেই পারি । আমি যদি আমার বাবার জন্য না করি তাহলে একটা বাইরের লোক নিজের লিভার কেন দেবে ? ১৮ বছর ধরে বাবার কাছে যা চেয়েছি সব দিয়েছেন । একদিনও না বলেননি । আমি তাঁর জন্য ৫ শতাংশ ঝুঁকি নিতে পারব না ? ওই দিনই আমি বন্ডেও সই করি ।
ETV ভারত : অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় আপনার পাশে কে কে ছিলেন ?
রাখি : আমার মা, দিদি, বন্ধুরা এবং মামা ।
ETV ভারত : আপনার অপারেশন নিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?
রাখি : তাঁরা যে চিন্তায় আছেন সেটা আমাকে বুঝতে দেননি । সকাল ৬ টায় আমাকে OT-তে ঢোকানো হয়েছিল । সেইসময় আমারও অল্প চিন্তা হচ্ছিল যে কী হবে । রাত ১১ টায় আমার জ্ঞান এসেছিল । তখন বুঝতেই পারছিলাম না আমার অপারেশন হয়ে গেছে । অপারেশনের পরের দিন আমার বাবা মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছিলেন । পরের দিনই ICU-র বিছানা ছেড়ে উঠে হেঁটেছিলেন। অপারেশনের পর তিন দিন পর্যন্ত আমি ভাবছিলাম এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে গেল কী করে ।