মুম্বই (মহারাষ্ট্র), 2 মে: রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা করেছেন শরদ পাওয়ার ৷ রাজ্যসভার সাংসদ পদের অবশিষ্ট তিন বছরের মেয়াদ শেষে আর নির্বাচনে লড়বেন না বলেও জানিয়েছেন এই মারাঠি রাজনীতিক ৷ 1999 সালে যে দল তিনি পিএ সাংমা ও তারিক আনোয়ারের সঙ্গে তৈরি করেছিলেন, সেই ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির সভাপতি পদ থেকেই সরে দাঁড়ানোর কথা জানিয়ে দিয়েছেন তিনি ৷ ফলে মারাঠা-ভূমি থেকে দিল্লিতে পৌঁছে জাতীয় রাজনীতির হেভিওয়েট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর সাড়ে ছয় দশকের যে লড়াই রয়েছে, তা সমাপ্ত হতে চলেছে ৷
82 বছর বয়সী শরদ পাওয়ারের জন্ম 1940 সালের 12 ডিসেম্বর ৷ মহারাষ্ট্রের সাতারার কাছে বারামতী গ্রামে তাঁর জন্ম হয় ৷ 1956 সালে ছাত্র রাজনীতি দিয়ে তাঁর রাজনীতিক হয়ে ওঠার সফর শুরু হয় ৷ গোয়াকে স্বাধীন ঘোষণা করার পর মহারাষ্ট্রের পরনগরে এক বিক্ষোভ হয় ৷ সেই বিক্ষোভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি ৷ 1958 সালে তিনি যুব কংগ্রেসে যোগদান করেন ৷ 1962 সালে তাঁকে পুনে জেলায় যুব কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত করা হয় ৷ ওই পদে তিনি দীর্ঘ সময় ছিলেন ৷ তার পর ধীরে ধীরে যুব কংগ্রেসে তাঁর উত্থান শুরু হয় ৷
শরদ পাওয়ারকে মূলত গ্রামীণ রাজনীতির জন্য জানা যেত ৷ 1967 সালে মাত্র 27 বছর বয়সে তিনি বারামতী থেকে জিতে প্রথমবার বিধায়ক হন ৷ ওই আসন থেকে এর পর বেশ কয়েকবার জিতে মহারাষ্ট্র বিধানসভায় গিয়েছেন এই মারাঠি নেতা ৷ বিধায়ক হিসেবে তাঁকে বারবার গ্রামীণ ইস্যুগুলি নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছে ৷ খরা, চিনি কল, সমবায়ের সমস্যা নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন তিনি ৷
1969 সালে সভাপতি পদে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইন্দিরা গান্ধিকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয় ৷ তখন শরদ ও যশবন্তরাও চহ্বন ইন্দিরার সঙ্গেই ছিলেন ৷ 1975 থেকে 77 সাল পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে শঙ্কররাও চহ্বন সরকারে শরদ ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৷ ওই সময়েই কংগ্রেসে আবার ভাঙন ধরে ৷ শরদ কংগ্রেস (ইউ) এর দিকে থেকে যান ৷ 1978 সালে কংগ্রেস (আই) ও কংগ্রেস (ইউ) পৃথকভাবে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করে ৷ তবে ওই দুই দলের জোট সরকার তৈরি হয় ভোটের পর ৷ মুখ্যমন্ত্রী হন বসন্তদাদা পাটিল ৷ সেই সরকারে শরদ পাওয়ার ছিলেন শিল্প ও শ্রমমন্ত্রী ৷
ওই বছর কংগ্রেস (ইউ) ছেড়ে জনতা দলের সঙ্গে মহারাষ্ট্রে সরকার গড়েন পাওয়ার ৷ ওই রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ৷ কিন্তু 1980 সালে ইন্দিরা গান্ধি কেন্দ্রের ক্ষমতায় ফেরার পর ওই সরকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে ৷ ফলে দু’বছরের পাওয়ারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় ৷ 1983 সালে পাওয়ার মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস (আই) এর সভাপতি হন ৷ বারামতী লোকসভা আসন থেকে জিতে সাংসদ হন ৷ 1985 সালে আবার তিনি বারামতীর বিধায়ক হন ৷ তখন মহারাষ্ট্রে রাজনীতি করার লক্ষ্যে তিনি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন ৷
আরও পড়ুন:পাওয়ারহীন এনসিপি অনাথ হয়ে পড়বে, শরদের দলের কর্মীদের বিক্ষোভে তপ্ত মহারাষ্ট্র
এর পর পাওয়ারের রাজনীতি মহারাষ্ট্র ও দিল্লির মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে ৷ 1988 সালে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী শঙ্কররাও চহ্বনকে কেন্দ্রের মন্ত্রী করে রাজীব গান্ধি ৷ তখন দ্বিতীয়বারের জন্য ওই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হন পাওয়ার ৷ দু’বছর পর বিজেপি ও শিবসেনা কংগ্রেসকে কড়া টক্কর দিয়েছিল ৷ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হন পাওয়ার ৷ 1991 সালে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি ৷ 1993 পর্যন্ত তিনি ওই মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন ৷
1993 সালে চতুর্থবারের জন্য মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হন শরদ পাওয়ার ৷ সেই সময় রাজনৈতিক চাপে সুধাকররাও নায়েক মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন ৷ তার পরই পাওয়ারকে মুখ্যমন্ত্রী করে কংগ্রেস ৷ 1995 সালে ওই রাজ্যে বিজেপি ও শিবসেনার জোট সরকার ক্ষমতায় আসে ৷ ফলে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষ হয় পাওয়ারের ৷ 1996 সালে বারামতী থেকে ফের লোকসভায় নির্বাচিত হন তিনি ৷
কিন্তু 1999 সালে তাঁকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয় ৷ কারণ, তিনি এবং পিএ সাংমা ও তারিক আনোয়ার সোনিয়া গান্ধির কংগ্রেসের সভানেত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন ৷ সাংমা ও আনোয়ারকেও বহিষ্কার করা হয় কংগ্রেস থেকে ৷ তাঁরা সেই সময় ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি তৈরি করেন ৷ সভাপতি হন শরদ পাওয়ার ৷ টানা 24 বছর তিনি ওই পদে ৷ এবার সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চান এই মারাঠি রাজনীতিক ৷
কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়েও বরাবর কংগ্রেসের কাছাকাছিই ছিলেন পাওয়ার ৷ 1999 সালে কংগ্রেসকে সমর্থন দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রে সরকার তৈরির জন্য ৷ 2004 সালে ইউপিএ তো যোগ দেয় তাঁর দল ৷ তিনি কেন্দ্রে কৃষিমন্ত্রী হন ৷ 2009 সালেও তিনি মন্ত্রিত্বে থেকে যান ৷ 2014 সালে ইউপিএ সরকারের পতন হওয়ায় কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব যায় পাওয়ারের ৷ পাশাপাশি মহারাষ্ট্রেও বিজেপি একক বৃহত্তম দল হয়ে শিবসেনার সঙ্গে সরকার গড়ে ৷
2019 সালে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে একই পরিস্থিতি তৈরি হয় ৷ কিন্তু সেবার শিবসেনাকে বিজেপির কাছ থেকে সরিয়ে এনে মহারাষ্ট্রে তৈরি হয় মহা বিকাশ আঘারি সরকার ৷ যে সরকারে মুখ্যমন্ত্রী হন উদ্ধব ঠাকরে ৷ উপ মুখ্যমন্ত্রী হন পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ার ৷ সরকারে কংগ্রেসও শরিক ছিল ৷ পুরো প্রক্রিয়ায় শরদ পাওয়ারই চাণক্য়ের ভূমিকায় ছিলেন বলে মনে করে রাজনৈতিক মহল ৷
তবে তাঁর সেই কৌশল বেশিদিন টেকেনি ৷ 2022 সালে শিবসেনার অন্দরে বিদ্রোহ হয় ৷ ফলে পতন হয় মহা বিকাশ আঘারি সরকারের ৷ এবার বিদ্রোহী শিবসৈনিকদের নিয়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান একনাথ শিন্ডে ৷ তিনিই মুখ্যমন্ত্রী হন মহারাষ্ট্রের ৷ তার পর মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে বড় কোনও হইচই পড়েনি ৷ যা মঙ্গলবার পাওয়ারের ঘোষণার পর হল ৷ যদিও পাওয়ারের এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ কর্মীরা ৷ তাই শেষ পর্যন্ত তিনি অবসর নেবেন, নাকি কর্মীদের দাবি মেনে থেকে যাবেন, সেটাই এখন দেখার !
আরও পড়ুন:এনসিপির সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ঘোষণা শরদ পাওয়ারের