সেবাগ্রাম, 2 অক্টোবর : 1930 সালের 12 মার্চ সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি যাত্রা শুরু করেছিলেন মহাত্মা গান্ধি ৷ ব্রিটেন’স সল্ট ল অফ 1882-এর বিরুদ্ধে সংগঠিত ওই আন্দোলন ইতিহাসে লবণ সত্যাগ্রহ নামেও পরিচিত ৷ ওই আন্দোলন শুরুর সময় গান্ধিজী সিদ্ধান্ত নেন, যতদিন না ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হচ্ছে, ততদিন তিনি আর ওই আশ্রমে ফিরবেন না ৷ সেদিন 78 জন অনুগামীকে নিয়ে লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন গান্ধিজী ৷
ওই আইন অনুযায়ী, লবণ তৈরির উপর কর বাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার ৷ আর ভারতীয়দের লবণ সংগ্রহ কিংবা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল ৷ 1930 সালের 6 এপ্রিল ডান্ডিতে লবণ তৈরি করে ওই আইন অমান্য করেছিলেন গান্ধিজী ৷ এই কারণে ওই বছর 4-5 মে মধ্যরাতে গ্রেফতার করা হয় গান্ধিজীকে ৷ যার প্রভাব গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল ৷ হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী গ্রেফতার বরণ করেন ৷ গান্ধিজী জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে পর্যন্ত এটা চলতে থাকে ৷
দু’বছর পর গান্ধিজী জেল থেকে মুক্তি পান ৷ তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে একটি গ্রাম তৈরি করবেন, যা হবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভরকেন্দ্র ৷ তাঁর অনুগামীর সঙ্গে সঙ্গে জায়গা খুঁজতে শুরু করেন ৷ কারণ, তিনি ভারতের স্বাধীনতার আগে সবরমতী আশ্রমে না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ৷
গান্ধিজীর খুব ঘনিষ্ঠ অনুগামী, যমনলাল বাজাজ পালাকওয়াড়ি (আজকের ওয়ার্ধা) জায়গাটি বেছে নেন ৷ সেবাগ্রাম মার্গকে গান্ধিজী তাঁর প্রথম সত্যাগ্রহ আশ্রম হিসেবে বেছে নেন ৷
সেবাগ্রাম আশ্রমের নাই তালিম ড. শিবচরণ ঠাকুর বলেন, ‘‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সারা দেশ ঘোরার পর গান্ধিজী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে দেশের স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সবরমতীতে ফিরবেন না ৷ এর পর আলোচনা শুরু হয় যে গান্ধিজী কোথায় থাকবেন ৷ এই সময় যমনলাল বাজাজ ওয়ার্ধার একটি জায়গার কথা বলেন ৷ তিনি গান্ধিজীকে এই জায়গার গুরুত্ব বোঝান ৷’’
1935 সালের জানুয়ারিতে তিনি মগনওয়াড়িতে ছিলেন ৷ কিন্তু গান্ধিজী একটা নিরিবিলি জায়গা চেয়েছিলেন মিস স্লেড ওরফে মীরাবেনের জন্য ৷ আর সেবাগ্রামই সেই জায়গা হয়ে ওঠে ৷ 1936 সালের 30 এপ্রিল প্রথমবার সেবাগ্রাম আশ্রমে যান গান্ধিজী ৷
স্বাধীনতা সংগ্রামের ভরকেন্দ্র ছিল সেবাগ্রাম আশ্রম গান্ধিজী প্রথমবার সফরের পর পাঁচদিন গৌভা গার্ডেনের কাছে একটি কুটিরে ছিলেন ৷ সেবাগ্রাম আশ্রেম আগে কোনও কুটির ছিল না ৷ কিন্তু একটি কুটির নির্মাণ করতে মাত্র 100 টাকা খরচ হত বলে গান্ধিজী সেখানে থাকতে বেশি পছন্দ করতেন ৷ স্থানীয় জিনিসপত্র ও শ্রমিকদের দিয়েই তা তৈরি করার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন তিনি ৷
1936 সালের 5 মে খাদি যাত্রা শুরু করেন গান্ধিজী ৷ ফিরে আসেন জুন মাসের 16 তারিখ ৷ ওই দেড়মাসে মীরাবেন ও বলবন্ত সিং আদি নিবাস তৈরি করেন ৷ যা তৈরি করতে খরচ হয় 499 টাকা ৷ যে খরচের কথা শুনে বিরক্ত হন গান্ধিজী ৷ 1937 সালের শেষের দিকে তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন যমনলাল বাজাজ ৷ তার পর গান্ধিজী মীরাবেন যে কুটিরে থাকতেন, সেখানে থাকা শুরু করেন ৷ পরে তা বাপু কুটি নামে পরিচিত হয় ৷ ছোট্ট ওই কুটিরটি পরে বড় করা হয় ৷ কুটিরের মধ্যে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র ও স্নানঘর তৈরি করা হয় ৷ পরে স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত বহু বৈঠকের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে ওই কুটিরটি ৷
তবে ওই কুটিরে থাকতে নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন গান্ধিজী ৷ সেই কারণে বাজাজ তাঁর জন্য আলাদা একটি কুটির তৈরি করে দেন ৷ গান্ধির আদর্শকে অমর করে রাখতে সেবাগ্রামে এখনও গান্ধিজীর ব্যবহৃত জিনিস রাখা রয়েছে ৷
গান্ধি ধর্মীয় বই পড়তেন ৷ সেবাগ্রাম আশ্রমে গেলে যে কেউ গান্ধিজীর ব্যবহৃত ছোট্ট আলমারিতে রামায়ণ, বাইবেল ও কোরান দেখতে পাবেন ৷ এছাড়াও সেখানে আছে গান্ধিজির বলা ‘খারাপ দেখো না, খারাপ শুনো না, খারাপ বলো না’ নীতির সেই তিন বাঁদরের ভাস্কর্য রয়েছে ৷ আর রয়েছে গান্ধিজীর ব্যবহৃত ভারতীয় পোশাক, চরকা ও সূচ৷ গান্ধিজীর ব্যবহৃত জপমালা, কাঠের ট্রফি, মার্বেল পেপারওয়েট এবং স্ক্রাব, নুড়ির পেপারওয়েট, নকল টুথপিক, পিকদানি, কলম এবং পেন্সিলের স্ট্যান্ডগুলি ৷
প্রাক্তন গর্ভনর জেনারেল ও ভারতের ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো গান্ধিজীর সঙ্গে যে কোনও সময় কথা বলার জন্য ওই কুটিরে একটি হটলাইন সংযোগস্থাপন করেছিলেন ৷ ব্রিটিশকে তাড়াতে ‘ভারত ছাড়ো’ স্লোগান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল ৷ সেটাই এই সেবাগ্রাম আশ্রমে তৈরি করা হয়েছিল ৷ 1942 সালের 9 জুলাই সেবাগ্রামে একটি বৈঠক হয় ৷ সেখানে ইউসুফ মেহেরাল্লি ‘গো ব্যাক, কুইট ইন্ডিয়া’ স্লোগানের প্রস্তাব দেন ৷ সেখান থেকেই আসে ‘ভারত ছাড়ো’ স্লোগানটি ৷
সেবাগ্রামের আনন্দ নিকেতনের ছাত্র নাত্তুজি চহ্বন বলেন, ‘‘সেবাগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান রাজধানী হয়ে উঠেছিল ৷ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখান থেকে নেওয়া হত ৷ বড় বড় নেতারা গান্ধিজীর সঙ্গে দেখা করতে এবং বাপুর কাছ থেকে নির্দেশ নেওয়ার জন্য সেবাগ্রামে আসতেন ৷’’
নথিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী, ভারত ছাড়ো আন্দোলন তৈরি হওয়ার পর সেবাগ্রাম আশ্রমে গান্ধিজী ফিরে এসেছিলেন ৷ সেবাগ্রাম আশ্রমে যা যা ঘটেছিল, তা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছিল ৷ ব্রিটিশের পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভারতে বছরের পর বছর ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলেছে ৷ প্রতিটি নাগরিক যাঁরা সেবাগ্রাম আশ্রমে এসেছিলেন, তাঁরা জাতীয়তাবাদ ও দেশাত্মবোধের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন ৷