দেশে বর্তমানে পথ নিরাপত্তা একটি মিথে পরিণত হয়েছে কারণ পথ দুর্ঘটনা লাখ লাখ পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে । এই ধারা বজায় রেখে, সম্প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশের প্রসিদ্ধ পর্যটন কেন্দ্র, আরাকু ভ্যালি থেকে ফেরার পথে, বিশাখাপত্তনমের কাছে একটি বিপজ্জনক বাঁক নিতে গিয়ে একটি বাস 200 ফুট গভীর খাদে পড়ে যায় । ঘটনায় 4 জনের মৃত্যু হয় এবং গুরুতর জখম হন 20 জন । নিহতরা তেলেঙ্গানার বাসিন্দা । ঠিক এর পরই একই রাজ্যের কুর্নুল জেলায় আরও একটি পথ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে, যেখানে 14 জনের মৃত্যু হয় । গত মাসে কর্ণাটকে একটি পথ দুর্ঘটনায় 13 জন বালিকার মৃত্যু হয়েছিল । পাশাপাশি, গুজরাতে রাস্তার ধারে ঘুমিয়ে থাকা 15 জন শ্রমিককে পিষে মেরে চলে যায় একটি দ্রুতগতির যান । এই মর্মান্তিক ঘটনার রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই পশ্চিমবঙ্গে একটি পথ দুর্ঘটনায় 14 জনের মৃত্যু হয় । পথ দুর্ঘটনার এই সংখ্যার কোনও শেষ নেই ।
গড়ে এক দিনে দেশে নানা ধরনের পথ দুর্ঘটনায় 415 জনের মৃত্যু হয় । একইরকমভাবে, প্রতি বছর সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ পথ দুর্ঘটনার জেরে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন । বিশ্বের অটোমোবাইলের মাত্র 1 শতাংশ ভারতে রয়েছে । তা সত্ত্বেও দেশে বিশ্বের মোট পথ দুর্ঘটনার 6 শতাংশ এখানেই হয় । সব ধরনের ঘটনা মিলিয়ে বিশ্বের সার্বিক পথ দুর্ঘটনার 11 শতাংশ ভারতে হয় ।
পথ দুর্ঘটনার নিরিখে বিচার করলে ভারত এবং জাপান একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে । যদিও প্রতি বছর জাপানে পথ দুর্ঘটনায় 500 জনেরও কম মানুষের মৃত্যু হয় । ঠিক তার বিপরীতভাবে, ভারতে পথ দুর্ঘটনায় প্রতি বছর 1.5 লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান । পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ পর্যবেক্ষণের প্রস্তাব কার্যকর হওয়া শুরু হয়েছিল আজ থেকে 32 বছর আগে । কিন্তু এই একই সময়ে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মানুষের বাঁচার অধিকারের উপর বড় প্রশ্ন চিহ্ন তুলে দিয়েছে । কেন্দ্র জানিয়েছে,পথ দুর্ঘটনা কোভিডের চেয়েও ভয়ংকর । কিন্তু তারা কি এই পরিস্থিতি ঠিক করতে কোনও উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে?
2011 থেকে 2020 সাল পর্যন্ত স্থায়ী দশকটিকে রাষ্ট্রসংঘের তরফে পথ দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপের দশক বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল । এর লক্ষ্য ছিল এই সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে হওয়া অন্তত 50 লাখ পথ দুর্ঘটনার সম্ভাব্য বলিপ্রদত্তের জীবন বাঁচানো । 2015 সালের ব্রাজিলিয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, তাদের লক্ষ্য হল 2020 সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে হওয়া পথ দুর্ঘটনাসমূহের মধ্যে অন্তত 50 শতাংশ হ্রাস করা । কিন্তু সেই লক্ষ্যপূরণে কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি । উল্টে দেশ ওই সময়ের মধ্যে পথ দুর্ঘটনায় 13 লাখ মৃত্যু এবং 50 লাখ মানুষের দুর্ঘটনার ফলে পঙ্গু হয়ে পড়ার সাক্ষী থেকেছে ।
এই সব মৃত্যুর মধ্যে 61 শতাংশেরও বেশি ঘটেছে জাতীয় এবং রাজ্য সড়কগুলিতে, যা দেশের সমগ্র রোড নেটওয়ার্কের মধ্যে 5 শতাংশেরও কম । যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে 70 শতাংশেরও বেশি মানুষের বয়স 18–45 বছরের কোঠায় । বিশ্বব্যাঙ্কের তরফে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল ভারতীয় সমাজে পথ দুর্ঘটনার ফলে হওয়া প্রভাব অনুধাবন করতে । সেই সমীক্ষায় এই সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছে যে, পথ দুর্ঘটনার জেরে অন্তত 75 শতাংশ পরিবারের আয় কমে গিয়েছে । এই সমস্ত পথ দুর্ঘটনায় দেশের জিডিপির অন্তত 7 লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে । কাজেই বিষয়টিকে সহজভাবে নেওয়া মোটেই উচিত হবে না ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রযুক্তির প্রয়োগ, সচেতনতার প্রচার, আইনের কঠোর বাস্তবায়ন এবং জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি তা আরও জোরালোভাবে কার্যকর করা হচ্ছে, ততক্ষণ কোনও ইতিবাচক ফলাফল মিলবে না । যেহেতু পথ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসাবে অতিরিক্ত গতিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে, তাই চালকদের মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত সচেতনতা, রাস্তার বিপজ্জনক বাঁক সারিয়ে তোলা এবং এই সংক্রান্ত অন্যান্য পদক্ষেপ অবিলম্বে গ্রহণ করা উচিত । জাতীয় সড়কে মদের দোকান বন্ধ করে দেওয়াও সমানভাবে দরকার ।
নিরাপদ যাত্রা তখনই সম্ভব যখন পথ নিরাপত্তাকে সামাজিক দায়িত্ববোধে পরিণত করা যাবে । আর তার জন্য সরকার, নাগরিক এবং সার্বিক নাগরিক সমাজের মধ্যে সুসংহত উদ্যোগ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি ।