নয়াদিল্লি, 28 জুন : জম্মু ও কাশ্মীরের বহু-কাঙ্ক্ষিত শান্তি অর্জন করা কখনওই সহজ কাজ ছিল না । শান্তি অর্জনের পথটা এতটাই জটিল ছিল যে ভূস্বর্গের বাসিন্দারা কখনও ভারত থেকে আলাদা হওয়ার দাবিতে বহিরাগত শক্তি দ্বারা পরিচালিত সন্ত্রাসবাদের থেকে মুক্ত একটি দীর্ঘ শান্তির পরিবেশ এবং পরিসীমা পায়নি ।
2019 সালের অগাস্ট মাসে কেন্দ্রীয় সরকার যখন সংবিধানের 370 ধারা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের আলাদা রাজ্য হিসাবে স্পেশাল স্টেটাস বাতিলের কথা ঘোষণা করে, তখন বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ এই পদক্ষেপকে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির বিশ্বাসঘাতকতা বলে বর্ণিত করে । 370 ধারা বাতিলের পর থেকেই জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়েই চলে । গ্রেফতার এবং গৃহবন্দী হন একাধিক রাজনৈতিক নেতা । অপরদিকে, বিজেপি দাবি করে যে এর ফলে রাজ্যে শান্তি ফিরে এসেছে ।
এই রাজনৈতিক দোষারোপের পালার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জম্মু ও কাশ্মীরের বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শান্তিপ্রক্রিয়ার পথে এক অন্য মাত্রা যোগ করে । 24 জুন এই বৈঠক ছিল একদম অপ্রত্যাশিত । যাই হোক । সবাই মনে করে যে এই বৈঠক পারস্পরিক বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এক সদর্থক পদক্ষেপ ৷ কারণ কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরকে আলাদা রাজ্যের তকমা দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বদ্ধপরিকর । ঠিক এটাই ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধান দলগুলির দাবি ।
কিন্তু এই বৈঠকের কিছুদিন পরেই জুনের 27 তারিখে জম্মুতে ভারতীয় বায়ুসেনার ঘাঁটিতে একটি ড্রোন-হামলা হয় ৷ যেটা ছিল ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম । জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের ডিরেক্টর জেনেরাল বিলবাগ সিং এই হামলাকে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ বলে অভিহিত করেন । এই ‘সন্ত্রাসী হামলার’ সময় জম্মু ও কাশ্মীরে একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অবস্থা অর্জন করার ক্ষেত্রে যে বাধাগুলি আছে সেইগুলি নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে দিল । তেমনই এই হামলা কেন্দ্রীয় সরকারের 370 ধারা বাতিলের স্বপক্ষে যে যুক্তি সেই যুক্তিকেও শক্তি যোগালো । কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করার পরে, সেনা এবং অন্যান্য সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ানরা ওখানকার অনেক সন্ত্রাসবাদীকে কব্জা করেছে । আবার কেউ কেউ নিজে থেকেই আত্মসমর্পণ করে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে এসেছে । এর ফলে কিছুটা হলেও শান্তির বাতাবরণ ফিরে এসেছে ।
আরও পড়ুন,ড্রোন ব্যবহার করে নাশকতা, উপত্যকার নিরাপত্তায় বড় চ্যালেঞ্জ
যে কোনও সরকারেরই লক্ষ্য থাকে যে সন্ত্রাসবাদ এবং হিংসা দমনের মাধ্যমেই শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা । অধুনা কেন্দ্রীয় সরকারও সেই লক্ষে এগিয়ে চলেছে এবং তাই এই ক্ষেত্রে সরকারের দাবির যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় । কিন্তু শান্তিপ্রক্রিয়ার পথে জটিলতা এতটাই বেশি যে সেই শান্তিকে পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা একটি কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায় । এই ক্ষেত্রে একটা বিশেষ জটিলতা হল পাকিস্তান বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আলোচনায় যুক্ত করা হবে কি হবে না সেই প্রশ্ন । এদের আলোচনায় যুক্ত করার মুশকিল হল আলোচনার প্রক্রিয়া জাতীয়তাবাদী এবং সার্বভৌমত্ব-প্ররোচিত দ্বিধা দ্বারা পরিচালিত হবে । আর এদের আলোচনায় যুক্ত না করলে সন্ত্রাসবাদের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে । প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের ঠিক কয়েকদিন পরেই জম্মুর বায়ুসেনা ঘাঁটিতে ড্রোন-হামলা সেদিকেই ইঙ্গিত করে ।
সংযুক্ত জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং পিডিএফ প্রধান মেহেবুবা মুফতি কিছুদিন আগে বলেন, আলোচনা প্রক্রিয়ার মধ্যে পাকিস্তান এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুক্ত করা প্রয়োজন । তাঁর এই যুক্তি যদিও অনেকেই ভালভাবে নেয়নি ৷ কিন্তু তাঁর এই যুক্তির মধ্যে শান্তিপ্রক্রিয়ার জটিলতাগুলি লুকিয়ে আছে ।
আরও পড়ুন,পুলওয়ামায় বাড়িতে ঢুকে স্ত্রী ও মেয়ে-সহ পুলিশ অফিসারকে গুলি করে খুন জঙ্গিদের
আসলে ভারতের আশেপাশের ভূ-রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির কথা এই প্রসঙ্গে ভেবে দেখতে হবে । আফগানিস্তান থেকে মার্কিনি সেনা সরে যাবার পর থেকেই সেখানে তালিবানদের আবার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে । লস্কর- ই- তইবা বা হিজবুল মুজাহিদিনদের মতো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীদের সঙ্গে তালিবানদের যোগসূত্র জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । একদিকে আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের শুরু, অন্যদিকে পাকিস্তানের ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দেওয়া এবং এর সঙ্গে 370 ধারা বাতিলকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করার মনোভাব শান্তিপ্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলবে ।
জম্মু ও কাশ্মীরে শান্তিস্থাপন কোনওদিনই সোজা কাজ ছিল না । এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার যেহেতু রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এক পদক্ষেপ করেছে, সেখানে কোনও বাধা ছাড়াই গতি অব্যাহত রাখা দরকার । প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নেতারা দাবি করেছিলেন সম্পূর্ণ রাজ্যের পুনরুদ্ধারের । এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা দরকার যাতে আস্থা ঘাটতি দূর হতে পারে এবং অভিযোগগুলি সমাধানের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হতে পারে । গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মন জয় করে এবং আলোচনার পথ প্রশস্ত করেই এই শান্তিস্থাপন করতে হবে ।