১. ভাষাখিচুড়ি কেন ?
প্রশ্নটা পুরনো, উত্তরটাও কারও কারও জানা নেই এমন নয়। ধরা যাক মধ্যবিত্ত, শহুরে বাঙালির কথার এই একটা টুকরো—“ওকে, সি ইয়ু, চলি ভাই, এক্ষুনি আমার বসের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে ছুটতে হবে, প্লিজ ভাই, ডোন্ট মাইন্ড, আমার ইয়ঙ্গার ব্রাদারের একটা জবের ব্যাপারে বস একটু প্রমিস করেছেন, তাই আইম ইন এ হারি, টাইম মেনটেন করতেই হবে, লেট হলে হয়তো চান্সটা মিস হয়ে যাবে। আমার হোম কন্ডিশন তো জানিসই, ফাদার রিটায়ার করেছেন অলমোস্ট ফাইভ ইয়ার্স, মা-বউ দুজনেই জাস্ট হাউসওয়াইফ, ওনলি আমি ফ্যামিলির জোয়াল টানছি। টা-টা।”
এই বানানো সংলাপটা কি খুব অবিশ্বাস্য ? কিন্তু এরকম বাংলা কথা তো বাংলাভাষী অঞ্চলের পথে-ঘাটে শোনা যায়, বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে আরও অনেক বেশি। রাজনৈতিক বক্তৃতায় তো ফুলঝুরির মতো এধরনের বাংলা ছোটে। এটা ইংল্যান্ড বা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নয় যে অল্পদিন প্রবাসী বাঙালি মা বাঙালি বেবিসিটারের কাছে বছর তিনেকের ছেলেকে রেখে বাইরে যাওয়ার আগে বলবে, “তুমি নটি হয়োনা বাপি, তোমার আন্টি তোমাকে ক্যারট দিয়ে রাইস মেখে দেবে, ইট লাইক আ গুড বয়, ও কে ? ফিরে এসে যেন না শুনি তুমি ব্যাডলি বিহেভ করেছ, ওকে ?” বা ওখানেই কোনো বাঙালি চাকুরে যুবক সদ্য-আলাপিতা গবেষিকা তরুণীকে বলবে, “নেক্সট ফ্রাইডে ইভনিং-এ আপনি ফ্রি আছেন কি ? চলুন না তা হলে একটু ডাইন-আউট করি, গল্পগুজবও হবে, আর ওদিন আর কুকিং-এর ঝামেলায় যাবেন না, আই প্রমিজ, আপনাকে আমি একটা ভালো সাপার কিনে দেব।”
বিদেশে এ রকম হতেই পারে। ইংরেজিভাষী দেশে ইংরেজিভাষার একাধিপত্য, সেখানে রেডিয়ো, টেলিভিশন সব ওই ভাষায় চলছে, রাস্তায় বেরোলেই ইংরেজি, সেখানে এমনটা হতেই পারে। বিদেশে যারা থাকে, তারা দেশে এসেও কথায় কথায় ও রকম ইংরেজি বলে ফেলে, পথে-ঘাটে, দোকানে-বাজারে।
কিন্তু যারা কস্মিনকালে বিদেশে যায়নি, সেই বাঙালিরা, বাংলাভাষী অঞ্চলে ? এই ফেব্রুয়ারি মাসে, আর মে মাসে আমাদের এই নিয়ে শোক উথলে ওঠে, হাহাকার পড়ে যায়—আমরা হইচই ঠাট্টা ইয়ার্কি ব্যঙ্গবিদ্রুপ শুরু করে দিই, যারা এ রকম করে তাদের ধরে ধরে এক হাত নিই। তাতে আমাদের মাতৃভাষাপ্রেমের জ্বলজ্যান্ত সব প্রমাণ খাড়া হয়। যারা "বাংলিশ" বলে তাদের যেন মুখদর্শন করতে চাই না আর। ভাবখানা এই যেন, আমরা নিজেরা কখনও বাংলিশ বলি না, ঘণ্টভাষা বলি নয়া। সবটাই অন্যরা বলে। আমরা ভালো, ওরা খারাপ। আমরা কি কখনও নিজেদের দিকে আয়না ঘোরাই ?
আরও পড়ুন :একুশের বইমেলা ও ঢাকা
প্রশ্নটা হল, কেন স্কুল-কলেজে পড়া মধ্যবিত্তের শহরে বাংলিশের এত ছড়াছড়ি ? প্রশ্নটা পুরোনো। উত্তরটা সকলের জানা নাও থাকতে পারে।
একটা উত্তর : খিচুড়ি ভাষা তখনই লোকে বলে যখন, কেউ যে ভাবেই হোক, দুটো ভাষার মধ্যে চলাচল করতে বাধ্য হয়, দুটো ভাষায় অল্পবিস্তর কাজ করতে করতে এগোয়। আমরা স্কুলে দুটো ভাষা শিখছি, কাজে-কর্মে দুটো ভাষা ব্যবহার করছি, কাজেই মুখের কথাতেও দুটো ভাষার উপাদান ঢুকে পড়ে, একটার সঙ্গে আর-একটা গুঁতোগুঁতি করতে করতে। বলছি বাংলা ভাষা, কিন্তু তার মধ্যে বাংলা কথাকে ছটকে দিয়ে ইংরেজি কথা ঝাঁপায়। যতক্ষণ ব্যাপারটা আলাদা আলাদা ছুটকো শব্দের ব্যাপার থাকে তখন তাকে বলে বুলি-মিশ্রণ (code mixing), আর যখন বাক্যের মধ্যে আলগা শব্দ ছিটোনো ছেড়ে দিয়ে পুরো বাক্য অন্য ভাষায় কেউ বলতে শুরু করে, তখন তার নাম হয়ে যায়, আমাদের বাংলায়, বুলি-লম্ফন (code mixing)। সেখানে দুটো ভাষারই ব্যবহার হয়, অর্থাৎ দ্বিভাষিকতা (bilingualism) চলে, সেখানে একটা থেকে আর-একটায় যাতায়াত চলতে থাকে। বুলি-মিশ্রণ বুলি-লম্ফন এক সঙ্গেও ঘটতে পারে, কোনও আটক নেই। বুলি-মিশ্রণে একটা ভাষা থাকে ভিত্তি, তাতে অন্য ভাষার শব্দ এসে বসে যায়। বুলি-লম্ফনে সে ভাষাটাকেই ছেড়ে যাই আমরা। উপরের প্রথম দৃষ্টান্তটা বুলি-মিশ্রণের। বুলি-লম্ফনের দৃষ্টান্ত হল—“আরে ভাই, কথা বলবেন না, I don’t’ want any scenes here. If you want to continue your family quarrels outside your residence, please go elsewhere. আমার কথাটা পরিষ্কার বুঝেছেন কি ?”
দুটো ভাষার মধ্যে বাস করা, যাপনে দুটো ভাষাকে জড়িয়ে নেওয়া—এ হল নিতান্ত পাটিগণিতের হিসেব। ওর্থাৎ এ রকম বুলি-মিশ্রণ বুলি-লম্ফনের ন্যূনতম শর্ত হচ্ছে যাকে বলে দ্বিভাষিকতা। একটি জনগোষ্ঠীর দুই ভাষার ব্যবহার। হয়তো তাদের ক্ষেত্র আলাদা—ঘরে মাতৃভাষা বলছি আর অফিসে আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বলছি লিখছি, কিন্তু তা হলেও নিজের ভাষাকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায় না। আমাদের ক্ষেত্রে বাংলায় অজস্র ইংরেজি ঢুকে পড়ে, বুলি-মিশ্রণ আর বুলি-লম্ফনের চেহারা নিয়ে।
আশ্চর্যের কথা হল, কিংবা মোটেই আশ্চর্যের কথা নয় যে, আমাদের ইংরেজিতে এভাবে মুড়িমুড়কির মতো বাংলা ঢোকে না। হ্যাঁ, আমাদের ইংরেজি দুর্বল হলে আমরা কেউ কেউ ইংরেজি বলতে গিয়ে আমরা মাঝে মাঝে বাংলা শব্দ ঘুঁজে দিই, যেমন “ইয়েস্ স্যার, ‘মানে’ আই ওয়ার্ক হিয়ার, স্যার ! মাই নেম ইজ, ‘যাকে বলে গিয়ে’ ইব্রাহিম তালুকদার স্যার ! আই অ্যাম এ ‘মানে কিনা’ ডিলিং ক্লার্ক, স্যার !” কিন্তু এ রকম ইংরেজি না বলবার চেষ্টাতেই আমরা জীবনপাত করি। অর্থাৎ দুটো ভাষা পাশাপাশি আছে, কিন্তু দুটো ভাষা যে খুব গোবেচারা আর নিষ্পাপ বন্ধুযুগলের মতো গলাগলি করে বাস করছে, কারও পাকা ধানে কেউ মই দিচ্ছে না তা নয়। এর মধ্যে অন্তত একটা ভাষা মই দেওয়ার জন্যে তৈরি। দ্বিভাষিকতার যে চেহারাটা আমাদের দেশে চলে সেটা হল subordinate bilingualism, অর্থাৎ পরাধীন দ্বিভাষিকতা, যেখানে একটা ভাষা অন্যের তুলনায় নানা দিক থেকে দুর্বল।
আরও পড়ুন :ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাজনীতির ভাষা...
২ শুধু দুটো ভাষা নয়, ভাষার গায়ের জোরের তফাত দেখুন
একটু আগেই বলছিলাম ইংরেজির মধ্যে খুব বেশি বাংলা শব্দ ঢোকেনি। কেন ? বাঙালির ইংরেজির মধ্যে যে বাংলা শব্দ ঢুকতে সাহস পায় না, কিন্তু বাংলায় প্রচুর ইংরেজি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে তার কারণ আর কিছুই না—ইংরেজি ভাষার গায়ের জোর বাংলাভাষার চেয়ে অনেক বেশি। ইংরেজি প্রথমে ছিল আমাদের বিদেশি শাসকদের ভাষা, এখন হয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির আর প্রযুক্তির ভাষা। বড়ো চাকরিবাকরি ইংরেজি না জানলে জুটবেই না। সেই সঙ্গে, আগে যেমন ছিল, এখনও সে রয়ে গেছে উচ্চশিক্ষার ভাষা, উচ্চতর জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাষা। বিদ্যাচর্চার যে কোনো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হতে হলে ইংরেজি বই আমাদের পড়তেই হবে। এই জন্যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের মাস্টারমশাইরা ইংরেজি পড়া, ইংরেজি বলার সঙ্গে ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখতেও বলতেন। এ ভাবে ইংরেজির অনিবার্যভাবে লেগে গেছে যাকে বলা হয় ভয়াবহ ‘প্রেসটিজ ফ্যাক্টর’, ইংরেজি বললে আমি পাশের ইংরেজি না-জানা লোকটার থেকে আলাদা হয়ে যাই, ‘বাবু’ হয়ে যাই। সে এক মহা সুখের অনুভব, প্রায় স্বর্গীয় আরামের বোধ—কিছু মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করার, অবজ্ঞা করার সুযোগ। আমি ওদের চেয়ে কত উন্নত! এ জন্যে যারা ইংরেজি জানে না তাদের আমরা প্রায় ‘অশিক্ষিত’ বলে গণ্য করি। ‘শিক্ষিত’ হল যারা স্কুলে ঢুকেছে, ইংরেজি পড়েছে, আর ‘অশিক্ষিত’ হল যারা ইংরেজি জানে না ! আমরা মনেই রাখি না যে-মানুষ non-literate, সে আদৌ অশিক্ষিত নয়, শুধু মাতৃভাষায় লিখতে পড়তে শিখেছে তারা, কিংবা অক্ষরজ্ঞান যারা পায়নি (কেন পায়নি সে কথা রাষ্ট্র জানে) তারাও ‘অশিক্ষিত’ নয়। যাক-গে সে দুঃখের কথা।
এই ‘অশিক্ষিতে’রা ইংরেজি জানে না, তাই তারা অনেকে হয়তো সেই আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি কুলির মতো বলতেও পারে, সাহেবের মুখে ‘ড্যাম’ গালাগাল শুনে—‘সাহেব, ড্যাম যদি ভালো কথা হয়, তবে আমি ড্যাম, আমার বাবা ড্যাম, আমার চোদ্দপুরুষ ড্যাম। আর ড্যাম যদি যদি খারাপ কথা হয়, তবে তুমি ড্যাম, তোমার বাবা ড্যাম, তোমার চোদ্দপুরুষ ড্যামড্যামাড্যামড্যাম !’ কিন্তু যারা একটু-আধটু ইংরেজি জানে ? তারা ইংরেজিভাষার গায়ের জোরের ব্যাপরটা সম্বন্ধে অনেক বেশি সচেতন। এত সচেতন যে তাদের গভীর অবচেতনে ঢুকে গেছে ব্যাপারটা। ফলে তাদের কথায়, তারা খেয়ালও করে না, আপনা থেকেই বাংলিশ বেরিয়ে আসে। ‘বাট আমি ওকে বললাম কী যে—‘, ব্যাপারটা প্র্যাকটিকালি একই হল। সো আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই !’
এই গায়ের জোর যে কত, মহিমা যে কতখানি, তা বেশ বোঝা যায় যখন আমরা ইংরেজি গালাগাল শুনে যত রাগ করি, বাংলা গালাগাল শুনে তত রাগ করি না। এটা রাস্তাঘাটে আপনারাও লক্ষ করেন না, তা নয়। বাসের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে কেউ কারও পা মাড়িয়ে দিয়েছে বলে—‘উহ, (পাশের লোককে জোর ধাক্কা দিয়ে) কী করছেন ? চোখে দেখতে পান না নাকি ?’ ‘কেন, কী হয়েছে ?’ ‘আরে মশাই, আমার ডানপায়ের কড়ে আঙুলটা যে থেঁতলে দিলেন !’ ‘ও, সরি !’ ‘আরে আপনি তো সরি বলেই খালাস, এখন আমার আঙুল নিয়ে হাসপাতালে না যেতে হয় ! এখনও কী প্রচণ্ড জ্বলছে, মনে হয় হাড় ভেঙে রক্ত বেরিয়ে পড়েছে !’ ‘তা দেখুন, ভিড়ের বাসে এ রকম একটু-আধটু হতেই পারে।‘ ‘হ্যাঁ, ‘হতেই পারে’, নিজেরা দেখবে না শুনবে না, আবার বলছে ‘হতেই পারে’।’ ‘আহ্ বলেছি তো সরি, এত রেগে যাচ্ছেন কেন ?’ ‘রেগে যাচ্ছি কেন ? কথা শোনো একবার ! যন্ত্রণায় আমার মাথা ঝিমঝিম করছে, আবার বলছে রেগে যাচ্ছি কেন ? আক্কেল দ্যাখো একবার !’ ‘আরে মশায়, অত যদি আপনার সমস্যা তো ট্যাক্সি করে গেলেই পারেন !’ ‘কী, নিজে দোষ করে আবার তড়পাচ্ছেন ! (ভেংচে) “ট্যাক্সি করে গেলেই পারেন !’ এ রকম চলতে চলতে তাপ চড়বে, শেষে একজন বলবে ‘শাট আপ !’ তখন অন্যজন হঠাৎ তুমিল জ্বলে উঠে প্রচণ্ড ক্রোধে বলবে, ‘কী, শাট আপ ? আপনি নিজে শাট আপ !’ এই ভাবে পথের ঝগড়াটা অন্য একটা বিপুলভাবে সফল মাত্রায় পৌঁছে যাবে। সহযাত্রীরা বিনাটিকিটের বিনোদন পাবেন।
আমি আগেও নানা জায়গায় লিখেছি আর বলেছি যে, এ কথাটা সবচেয়ে বেশি করে বুঝেছিলেন বাঙালির মধ্যে এক ভদ্রলোক, যাঁর নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর সময়ে তাঁর মতো ইংরেজি জানা লোক ভারতীয়দের মধ্যে কম ছিল। তাঁর একেই কি বলে সভ্যতা প্রহসন থেকে একটা উদ্ধৃতি আমি আগে ব্যবহার করেছি, এখানেও তুলছি।
নব আর কালী দুই বন্ধু বারবনিতা-পল্লিতে একটি বাড়িতে অন্য বন্ধুদের বেশ অপেক্ষায় রেখে একটু দেরি করে ঢুকেছে। অন্য বন্ধুরা তখনই কিছুটা রসস্থ, তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার উপক্রম। এদের মধ্যে নবকে ঈর্ষ্যা করে এমনও দু-একজন আছে। ঢুকে নব বলছে—