নয়াদিল্লি, 4 নভেম্বর: প্রায় দেড় বছর পর রাশ টানা হল পেট্রল-ডিজেলের দামে ৷ তার পরেও সমালোচনা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না কেন্দ্র ৷ এত দিন মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কানে না তুললেও, উপনির্বাচনের ‘ভরাডুবি’তে ভয় পেয়েই সাত তাড়াতাড়ি উৎপাদন শুল্ক কমানো হল বলে অভিযোগ বিরোধীদের ৷ তাদের দাবি, জ্বালানির উপর থেকে এই শুল্ক হ্রাস আসলে উপনির্বাচনের ফলাফলের ফসল ৷
জ্বালানির চড়া মূল্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগে চলেছেন বিরোধীরা ৷ তা নিয়ে কটাক্ষ করতে গিয়ে ‘পকেটমার হইতে সাবধান’ বলেও সাধারণ মানুষকে সতর্ক করেন কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধি ৷ তাতে এত দিন কোনও গা না করলেও, বুধবার আচমকাই পেট্রল-ডিজেলের উপর থেকে উৎপাদন শুল্ক কমিয়ে দেয় কেন্দ্র ৷
রাজনৈতিক স্বার্থেই কেন্দ্র উৎপাদন শুল্ক কমাতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করছেন কংগ্রেস সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদম্বরম ৷ বৃহস্পতিবার টুইটারে তিনি লেখেন, ‘30টি বিধানসভা এবং 3টি লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের ফলাফল থেকে একটি উপজাত ফসলের আমদানি ৷ পেট্রল-ডিজেলের উৎপাদন শুল্ক হ্রাস করেছে কেন্দ্র ৷ আমরা দীর্ঘদিন ধরেই তা বলে আসছিলাম, চড়া শুল্কের জন্যই যে জ্বালানির দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে ৷ কেন্দ্রের লোভের জন্যই হয়রান হচ্ছেন সাধারণ মানুষ ৷ আজ তা প্রমাণ হয়ে গেল ৷ ’
যদিও যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী । চিদম্বরমের অভিযোগের পাল্টা তাঁর জবাব, ‘‘মানুষের চাহিদার তোয়াক্কা না করে এই ধরনের অভিযোগ অত্যন্ত স্পর্শকাতর । মানুষের দুঃখ বুঝি আমরা । তাই সব অভিযোগে মুখ বুজে রয়েছি । মানুষের সুখ-দুঃখ পাশে আছি আমরা ।’’
আরও পড়ুন:Yogi Adityanath: দোল পর্যন্ত বিনামূল্যে রেশন, ভোটের আগে কল্পতরু যোগী
পেট্রল-ডিজেলের দাম 100-র কোঠায় নিয়ে যাওয়ার পর 5-10 টাকা ছাড় দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে। তাঁর কথায়, ‘‘গত 18 মাসে 35 টাকা বাড়ানোর পর মোদি সরকার 5 টাকা শুল্ক কমিয়েছে ৷ ইউপিএ আমলের শুল্কে ফিরে যেতে হবে তাদের ৷ তবেই রক্ষা পাবেন মানুষ ৷ তবে মনে হচ্ছে, বিজেপি যত ভোটে হারবে, ততই দাম কমবে পেট্রল-ডিজেলের ৷’’
পেট্রল-ডিজেলের দাম নিয়ে লাগাতার কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে বাংলা । অবশেষে শুল্ক কমানো নিয়ে সরাসরি নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহকে একহাত নেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন । টুইটারে লেখেন, ‘‘মতি ফিরল তাহলে । গত কয়েক মাস ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হয়রান করে, যন্ত্রণা দিয়ে পেট্রল-ডিজেলের দামে নয়া চমক স্টান্ট মাস্টার এম এবং এস-এর । ’’
এত দিন যে চড়া দামে জ্বালানি বিক্রি হয়েছে, সেই তুলনায় দাম তেমন কমানো হয়নি বলেও অভিযোগ করেন ডেরেক । তাঁর কথায়, ‘‘গত বছর পেট্রলের উপর শুল্ক বাড়ানো হয় 65 শতাংশ । এখন কমানো হল 15 শতাংশ । এবছর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পেট্রলের বর্ধিত শুল্ক থেকে সরকারের আয় গত বছরের তুলনায় 33 শতাংশ বাড়ে । কোভিডের আগে যা আয় হত, পেট্রল-ডিজেল থেকে সরকার এখন তার চেয়ে 79 শতাংশ বেশি আয় করে ।’
দীর্ঘ টানাপড়েনের পর বৃহস্পতিবার পেট্রল-ডিজেলের উৎপাদন শুল্ক হ্রাস করে কেন্দ্র ৷ প্রতি লিটার পেট্রলে 5 টাকা কমানো হয় উৎপাদন শুল্ক ৷ লিটার প্রতি ডিজেলের উৎপাদন শুল্ক কমানো হয় 10 টাকা ৷ কেন্দ্রের সেই ঘোষণার পরই বিজেপিশাসিত অসম, ত্রিপুরা, মণিপুর, কর্নাটক, গোয়া, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, হরিয়ানা, হিমাচলপ্রদেশ এবং উত্তরখণ্ডেও পেট্রল-ডিজেলের উপর থেকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) কমানো হয় ৷ বিজেপির মিত্র হিসেবে পরিচিত ওড়িশার বিজু জনতা দলের (বিজেডি) সরকারও দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় ।
আরও পড়ুন:Punjab Congress : বিধানসভা ভোটের আগে ঘরে-বাইরের দ্বন্দ্বে জেরবার পঞ্জাব কংগ্রেস
এত দিন পেট্রল-ডিজেলের দামের প্রসঙ্গ উঠলে নানা যুক্তি দিতেন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা ৷ ‘সস্তায় পেট্রল চাইলে আফগানিস্তান চলে যান’, ‘বিনামূল্যে টিকা পাচ্ছেন, সেই যথেষ্ট নয় কি’, এমন মণিমুক্তোও ঝরে পড়েছে তাঁদের মুখ থেকে ৷ কিন্তু বুধবার কেন্দ্রের ঘোষণার পরই একযোগে নরেন্দ্র মোদীর বন্দনায় নেমে পড়েন বিজেপির ছোট-বড় সব নেতা-মন্ত্রীরা ৷ দীপাবলির আগে দেশবাসীর হাতে অনন্য উপহার তুলে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করতে দেখা যায় তাঁদের ৷
তাই দাম সমান্য কমানোর পর যে ভাবে বিজেপি নেতারা মোদিস্তূতিতে নেমে পড়েন তার তীব্র নিন্দা করেন বিরোধী শিবিরের নেতারা । সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা লাঘবে নয়, উপনির্বাচনের ফলাফল দেখে মনে ভয় জেগেছে, তাই সাত তাড়াতাড়ি পেট্রল-ডিজেলের উপর থেকে শুল্ক কমিয়ে মানুষের ক্ষোভ সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা ।
উল্লেখ্য, চড়া শুল্কের জেরে গত এক বছরেই প্রতি লিটারে পেট্রলের দাম বাড়ে 26 টাকা । গত 12 মাসে প্রতি লিটারে ডিজেলের দাম বেড়েছে 25 টাকা । শুধু পেট্রল-ডিজেল থেকে 2018-’19 সালে সরকারের আয় হয় 2.3 লক্ষ কোটি টাকা । 2.5 কোটি টাকা আয় হয় 2017-’18 সালে । কিন্তু অতিরিক্ত হারে দাম বাড়তে থাকায় এবছর শুধুমাত্র এপ্রিল-জুলাই মাসেই কেন্দ্রের আয় হয় 1 লক্ষ কোটি টাকা । তা নিয়ে লাগাতার কেন্দ্রের উপর চাপ দিয়ে আসছিল বিরোধী দলগুলি । তাতেই শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র অবস্থান বদলাল বলে মনে করা হচ্ছে ।
কেন্দ্রের ঘোষণার পর গোয়া সরকার পেট্রল-ডিজেলের উপর থেকে প্রতি লিটারে 7 টাকা ভ্যাট কমিয়েছে । উত্তরাখণ্ডে পেট্রলের দামের উপর থেকে ভ্যাট কমানো হয়েছে 2 টাকা । হরিয়ানা দুই জ্বালানির উপর থেকেই ১২ টাকা প্রতি লিটারে ভ্যাট কমানো হয়েছে । ওড়িশায় প্রতি লিটারে 3 টাকা কমানো হয়েছে পেট্রল-ডিজেলের দাম ।