কলকাতা, 15 অগস্ট : যাঁর পরাক্রমে ঘুম ছুটেছিল ব্রিটিশ শাসকের, সেই তিনিই কি না ছিলেন ইংলিশ ব্রেকফাস্টের পরম ভক্ত ! তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhas Chandra Bose) ৷ নেতাজিকে বাগে আনতে বেশ কয়েকবার তাঁকে নজরবন্দি করে রাখতে হয়েছিল ব্রিটিশদের ৷ 1936 সালের জুন মাসে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয় দার্জিলিংয়ের গিদ্দা পাহাড়ে ৷ টানা ছ’মাস সেখানেই আটক ছিলেন তিনি ৷ শোনা যায়, সেই সময় প্রতিদিন সকালে পাউরুটি আর পুডিং দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতেন নেতাজি ৷ বাঙালি হয়েও লুচি, পরোটা মুখে রুচত না তাঁর ৷ মন মজেছিল শাসকের ডেলিকেসিতে ৷ আর এখানেই ছিল ‘কাহানিমে টুইস্ট’ ৷ আসলে দিনের পর দিন পাউরুটি চিবোনো তো ছিল অছিলা মাত্র ৷ নেতাজির লক্ষ্য ছিল অন্য কিছু ৷ শাসকের বাঁধনে বাঁধা পড়বেন, এমন মানুষ তিনি ছিলেন না ৷ গৃহবন্দি থেকেও স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার গুরুদায়িত্ব সামলে ছিলেন তিনি ৷ তার জন্য বহু মানুষের সঙ্গে খবর আদান-প্রদান আবশ্যিক ছিল ৷ ভরসা ছিল হাতে লেখা চিঠি ৷ কিন্তু সেই চিঠি প্রাপকের কাছে পাঠাবেন কীভাবে নেতাজি ? সেই বন্দোবস্ত করতেই সাত সকালে পাউরুটি আর পুডিংয়ের অবতারণা ৷ এই পাউরুটি ভিতরেই লুকিয়ে চিঠি চালাচালি করতেন সুভাষচন্দ্র ৷
গিদ্দা পাহাড়ে নজরবন্দি থাকার সময় কারোরই নেতাজির কাছে যাওয়ার অনুমতি ছিল না ৷ ব্য়তিক্রম ছিলেন শুধুমাত্র কালু সিং লেপচা ৷ সেই ছ’টা মাস একনিষ্ঠভাবে নেতাজির সেবা করেছিলেন তিনি ৷ আগলে রেখেছিলেন দেশনায়ককে ৷ নেতাজির লক্ষ্য কালু সিংয়ের অজানা ছিল না ৷ তিনি জানতেন, ঘরবন্দি সুভাষের পক্ষে দেশের কাজ চালিয়ে যাওয়া সহজ নয় ৷ তাই সাধ্যমতো নেতাজিকে সাহায্য করেছিলেন তিনি ৷ প্রতিদিন সকালে তিনিই নেতাজির ঘরে ব্রেকফাস্ট নিয়ে যেতেন ৷ নেতাজি পাউরুটি কিছুটা খেতেন, বাকিটুকু ফেরত পাঠাতেন ৷ সেই বেঁচে যাওয়ার পাউরুটির ফাঁকেই গোঁজা থাকত গোপন চিঠি ৷ পরে সেই চিঠি জুতোর সোলে লুকিয়ে কলকাতায় পৌঁছে দিতেন কালু ৷ এক কথায় বলতে গেলে ব্রিটিশকে শিক্ষা দিতে তাদেরই খাদ্যাভ্য়াসকে ঢাল করে ছিলেন নেতাজি ৷ আর সেই কাজে তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন কালু সিং লেপচা ৷
আরও পড়ুন,পরাধীন ভারতে গৃহবন্দি হতে হয়েছিল কলকাতার তৎকালীন প্রাক্তন মেয়র সুভাষচন্দ্রকেও
কালু সিং লেপচার একটি ছোট্ট মেয়ে ছিল ৷ তার নাম মোতি ৷ শোনা যায়, মোতি আর তার বন্ধুদের সঙ্গে ভারী ভাব ছিল নেতাজির ৷ আসলে বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন সুভাষচন্দ্র ৷ তাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন ৷ অনর্গল কথা বলে যেতেন হিন্দিতে ৷ মোতি যখন বড় হন, তখনও সেই স্মৃতি ভোলেননি ৷ বহুবার বহু মানুষকে ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা বলেছেন তিনি ৷ আজ তাঁর বংশধররা সেইসব ‘গল্প’ অন্যদের শোনান ৷ কালু সিং লেপচার মতো তাঁর মেয়ে মোতিও আজীবন গিদ্দা পাহাড়ের এই বাড়িতে কাজ করে গিয়েছেন ৷
প্রসঙ্গত, গিদ্দা পাহাড়ের এই বাড়িটি কিনেছিলেন নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসু ৷ সেটা ছিল 1922 সাল ৷ তারপর থেকে বছরে অন্তত দু’বার এই বাড়িতে সপরিবার ছুটি কাটাতে আসতেন শরৎচন্দ্র ৷ সঙ্গে থাকতেন ভাই সুভাষও ৷ এই ধারা চলে 1935 সাল পর্যন্ত ৷ ততদিনে সুভাষচন্দ্র ক্রমেই ব্রিটিশ সরকারের ত্রাসে পরিণত হয়ে উঠেছেন ৷ সেই কারণেই একাধিকবার তাঁকে নজরবন্দি হতে হয় ৷ গিদ্দা পাহাড়ের ছ’টা মাসও ছিল সেই অধ্যায়েরই একটা অংশমাত্র ৷ নিজেদের বাড়িতেই নেতাজি তখন ‘বন্দি’ ৷ পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিকে সংরক্ষিত করে রাখতেই বাড়িটিকে সংগ্রহশালায় পরিণত করা হয় ৷ 1996 সালে বাড়িটি অধিগ্রহণ করে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর ৷ সেটিকে সংস্কার করে তুলে দেওয়া হয় ‘নেতাজি ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ’-এর হাতে ৷ এখন সেখানেই তৈরি হয়েছে মিউজিয়াম ৷ যার প্রতিটি অংশে আজও মিশে রয়েছেন নেতাজি, তাঁর আবেগ, দেশপ্রেম, ভালবাসা আর দীর্ঘ সংগ্রাম ৷
নজরবন্দি হয়েও অপ্রতিরোধ্য নেতাজি, গোপন চিঠি পাঠাতেন পাউরুটির স্লাইসে নেতাজি মিউজিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক গণেশ প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি ৷ তিনি আমাদের জানান, গিদ্দা পাহাড়ে নজরবন্দি থাকাকালীন মোট 26টি চিঠি লিখেছিলেন নেতাজি ৷ এর মধ্যে 11টির প্রাপক ছিলেন নেতাজির প্রেয়সী এমিলি শেঙ্কেল ৷ অন্যদিকে, এমিলির তরফ থেকেও নেতাজির জন্য 10টি চিঠি এসে পৌঁছেছিল গিদ্দা পাহাড়ের এই ‘বন্দিশালা’য় ৷ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্য়ায় রচিত বন্দেমাতরমের শব্দচয়ন নিয়ে একবার একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ৷ শোনা যায়, সেই বিষয়টি নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জওহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখেছিলেন নেতাজি ৷ সেই চিঠিও তিনি লিখেছিলেন এই বাড়িতে বসেই ৷ এছাড়া, হরিপুরা কংগ্রেসে নেতাজি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার খসড়াও নেতাজি প্রস্তুত করেছিলেন এখানেই ৷ প্রসঙ্গত, জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনটি হয়েছিল 1938 সালে ৷ সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বেই সেই অধিবেশন হয়েছিল ৷
তবে শুধুমাত্র নেতাজি নন, গিদ্দা পাহাড়ের এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন আরও এক কিংবদন্তী ৷ তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (Deshbandhu Chittaranjan Das) ৷ মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন দেশবন্ধু ৷ সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী বাসন্তী দেবী ৷ সেইসব স্মৃতি আজও যতটা সম্ভব সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে ৷ রয়েছে এমিলি শেঙ্কেলের ছবিও ৷