নয়াদিল্লি, 16 নভেম্বর : বিতর্ক এবং তিনি, চিরকালই এক নৌকোর সওয়ারি । ভারত দ্বিতীয় বাসভূমি হলেও, লেখিকা তসলিমা নাসরিন এখন সুইডেন নিবাসী । কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ের থাকলেও, উপমহাদেশের রাজনীতি, সমাজ, পরিস্থিতি নিয়ে একই ভাবে সরব তিনি । এ বার বিদেশ থেকেই ইটিভি ভারতের কাছে সব কিছু নিয়ে মুখ খুললেন তসলিমা । জানালেন, ভারতে সংখ্যালঘুদের আশঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই । কোনও ঝুঁকি নেই ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান বদলের । বরং তসলিমার যাবতীয় উদ্বেগ পাকিস্তান এবং নিজভূম বাংলাদেশ নিয়েই । ভারতের পরিস্থিতি কখনও পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো হবে না বলে আত্মবিশ্বাসী তিনি । তবে মহিলাদের মাথানত করে থাকতে বাধ্য করা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কোনও রাখঢাক করলেন না তসলিমা ।
ইটিভি ভারত : দীর্ঘ দিন ভারতে ছিলেন । আরও অনেক দেশে থেকেছেন, গোটা পৃথিবী ঘুরেছেন, সেখানকার সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন । সেই অভিজ্ঞতা কেমন ?
তসলিমা নাসরিন: হ্যাঁ, ইউরোপ, আমেরিকা এবং ভারত উপমহাদেশের অনেক দেশের সমাজব্যবস্থাকেই কাছ থেকে দেখেছি । ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক এবং নারীবিদ্বেষী । গণতন্ত্র রয়েছে, কিন্তু সঠিক অর্থে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা নেই । বাক স্বাধীনতা রয়েছে, কিন্তু তা-ও অসম্পূর্ণ । মহিলাদের অধিকার রয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। সমানাধিকার রয়েছে, মহিলাদের প্রতি সম আচরণও রয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ নয় কোনওটাই । কারণ এখনও অনেক রীতিনীতি, প্রথা এবং সংস্কৃতি রয়েছে, যা নারীবিরোধী । যে সমস্ত ধর্মীয় আইন রয়েছে, সব নারীবিরোধী এবং তার জন্যই মহিলারা সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত হন । সে সব অর্জন করতে উপমাহাদেশের মহিলাদের সামনে এখনও দীর্ঘ লড়াই ।
যে সমস্ত দেশ মানবাধিকার এবং ধর্মকে আলাদা করতে পেরেছে, সেখানে বাক স্বাধীনতার ব্যাপ্তি অনেক বেশি এবং মহিলারাও অনেক বেশি অধিকার পান । তাই রাষ্ট্র এবং ধর্মকে আলাদা করা প্রয়োজন । ধর্মের উপর ভিত্তি করে আইন তৈরি করা উচিত নয় । শুধুমাত্র সমানাধিকারের ভিত্তিতেই আইন তৈরি হওয়া উচিত ।
ইটিভি ভারত : ধর্মের উপর ভিত্তি করে তৈরি আইন এই মুহূর্তে ভারতে নেই । সে ক্ষেত্রে ভারতে মহিলাদের অবস্থা কি ঠিক বলে মনে হয় আপনার ?
তসলিমা নাসরিন: যে সমস্ত সমাজ ধর্মীয় আইন মেনে চলে, সেখানে মহিলাদের অবস্থা ভাল নয় । সেই নিরিখে ভারতের মহিলাদেরও সমানাধিকার নেই । দেখুন, মুসলিমদের ব্যক্তিগত আইন-শৃঙ্খলা কিন্তু ধর্মের উপর ভিত্তি করেই তৈরি । বাকিদের জন্য 1956 সালেই আইন সংশোধন করা হয় এবং তার জেরে অন্য সম্প্রদায়ের মহিলারা স্বাধীনতাও পেয়েছেন এবং তা উপভোগও করেন । তা সত্ত্বেও যে সমস্ত সমাজ চিরাচরিত ঐতিহ্য এবং প্রথা বুকে আঁকড়ে বাঁচে, সেখানে মহিলাদের অবস্থা ভাল নয় । তাঁদের সমানাধিকার নেই । নেই স্বাধীনতাও । তাই এমন সমাজে মহিলাদের সমান সুযোগ সুবিধা পেতে অনেক সমস্যা হয় ।
ইটিভি ভারত: আপনি বলছেন মুসলিম পার্সোনাল ল-র জন্যই মহিলাদের অবস্থা ভাল নয় । সে ক্ষএত্রে মুসলিম সমাজের কোও নেতা ওই আইন সরিয়ে মহিলাদের স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলছেন না ?
তসলিমা নাসরিন : মুসলিমদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে । বাংলাদেশের দিকেই তাকান । সেখানে যাঁরা সংখ্যালঘুর গোত্রে পড়েন (হিন্দু), তাঁরাও মহিলাদের স্বাধীনতা চান না । মহিলাদের সমানাধিকারেরও বিরোধী তাঁরা । তাঁদের জীবনও মুসলিম পার্সোনাল ল-র উপরই ভিত্তি করেই চলছে । সেখানে মহিলাদের বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার পর্যন্ত নেই ।
ইটিভি ভারত: আমার অন্য প্রশ্ন । মুসলিম সমাজ থেকে সঠিক দিশা দেখানোর কোনও নেতা উঠে এলেন না কেন?
তসলিমা নাসরিন : বোঝাপড়ার অভাব তো রয়েইছে । সমানাধিকার নিয়ে কথা বলারই সুযোগ পান না মহিলারা । কারণ ধর্ম তাঁদের পদদলিত করে রাখে । শিক্ষার সুযোগ পেয়ে কিছু মুসলিম বিষয়টি বুঝেছেন, কিন্তু যাঁদের সেই চেতনা হয়নি, তাঁদের সংখ্যাটা অনেক বেশি । কারণ তাঁদের শিক্ষাও নেই, না আছে কর্মসংস্থানের সুযোগ । আজও অন্ধকারেই বেঁচে রয়েছেন তাঁরা । মাদ্রাসা যান, মসজিদ যান । বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনাই নেই, যা কি না আজকের দিনে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ।
একজন মুসলিমকেই মুসলিম সমাজকে দিশা দেখাতে হবে, তা বাধ্যতামূলত নয় । যদি কেউ নেতা হন, তিনি সব ধর্মের মানুষের নেতা । ধর্ম, ব্যক্তি আদর্শের ঊর্ধ্বে তিনি । তাঁর উচিত ধর্মের বিচার না করে, সকলকে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ দেখানো । ধর্মীয় পশ্চাৎগামিতা থেকে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনারর পথে বার করে আনতে হবে মানুষকে । নেতাকে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে, যাতে সব সম্প্রদায়কে নিয়েই ভাবতে পারেন তিনি ।
মহিলাদের স্বাধীনতা, তাঁদের সমানাধিকার নিয়ে কথা বলতে হবে নেতাকে । মুসলিমদের নেতাকে মুসলিমই হতে হবে, এই চিন্তা সঠিক নয় । এটাও পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনার সঙ্গেত । নেতাকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল হতে হবে । তবেই সব সম্প্রদায়ের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে পারবেন তিনি ।